পশ্চিমবঙ্গে নিন্দার ঝড়
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ভারতের হাতে গোনা যে ক'জন নোবেল সম্মান বিজয়ী আছেন, তাঁদেরই একজন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন৷ তাঁর অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দর্শন সারা বিশ্বেই স্বীকৃত, সম্মানিত৷ যদিও তিনি বহু বছর ধরে আমেরিকার বাসিন্দা, এবং জীবন যাপনে তিনি আন্তর্জাতিক, কিন্তু অমর্ত্য সেন বাঙালি বলে, বাকি বাঙালিদের বিশেষ গর্বের কারণ৷ এহেন মানুষটি সম্পর্কে বিজেপি'র রাজ্য সভাপতি, খড়গপুরের বিধায়ক দিলীপ ঘোষের মূল্যায়ণ, ‘‘আমাদের একজন বাঙালি নোবেল পেয়েছেন৷ তিনি কী করেছেন, বাংলার কেউ বোঝে না! সম্ভবত তিনি নিজেও বোঝেননি৷ কিন্তু তিনি কী দিয়েছেন দেশকে? দেশের জন্যে কী করেছেন উনি?''
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জমানায় দেশের অন্যতম উৎকর্ষ কেন্দ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন অমর্ত্য সেন৷ ২০১৫ সালে৷ কারণ, জল্পনা ছিল, মোদি সরকারের ‘হ্যাঁ'-তে ‘হ্যাঁ' না মেলানোর অপরাধে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে৷ কার্যত তা-ই হয়েছিল৷ অমর্ত্য সেন ইস্তফা দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতি থেকেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ সে প্রসঙ্গে দিলীপ ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘ওঁকে নালন্দার উপাচার্য পদ থেকে হটানো হয়েছে, তাতে (কিছু লোকের) খুব কষ্ট হচ্ছে!''
অটল বিহারী বাজপেয়ির প্রধানমন্ত্রিত্বে পূর্বতন এন ডি এ সরকারের আমলে যে অমর্ত্য সেনকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক খেতাব ‘ভারতরত্ন' দেওয়া হয়েছিল, তাঁর সম্পর্কে এরপর দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘যাদের কোনও মেরুদণ্ড নেই, চরিত্র নেই, এ রকম লোকের জন্য আজ বাঙালির গর্ব হচ্ছে! এদের কেনা যায়, বিক্রি করা যায়! চমকানো যায়! (এরা তখন) পায়ে পড়ে যায়৷''
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ সম্পর্কে বিজেপি রাজ্য সভাপতির এই উষ্মা এবং অসম্মানজনক মন্তব্যের কারণ অবশ্য সহজেই অনুমেয়৷ মোদী সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচকদের অন্যতম অমর্ত্য সেন৷ তিনি প্রকাশ্যে এবং নির্দ্বিধায় এই সিদ্ধান্তের ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, যা বিজেপি'র অস্বস্তির কারণ হয়েছে৷ কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় দিলীপ ঘোষের এই কুরুচিকর মন্তব্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে বাঙালি মানসে৷ সমালোচিত হচ্ছেন দিলীপ ঘোষ ও তাঁর দল৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ চলছে দিলীপ ঘোষের ‘তিনি কী করেছেন, বাংলার কেউ বোঝে না' মন্তব্য নিয়ে৷
রাজনৈতিক মহলও প্রতিবাদে সরব৷ রাজ্য সরকারের পরিষদীয় মন্ত্রী, তৃণমূল কংগ্রেস নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘লজ্জাজনক৷ বাঙালির মাথা হেঁট হয়ে গেল ওই একটা কথায়৷'' প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি বলেছেন, ‘‘বিজেপি'র যা সংস্কৃতি, এদের থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশাই করা যায় না৷'' সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘পাড়ার কে কী বলল, তা নিয়ে মাথাব্যাথা নেই৷ আমাদের কাছে অমর্ত্য সেন মানে বাঙালির গর্ব৷'' সিপিএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘হম্বিতম্বি করে রাজনীতি হয় না৷ রাজনীতিটা সমাজের জন্য, সংস্কৃতির জন্য৷ রাজনীতির সহজ পাঠটাই এখনও শেখেননি দিলীপ ঘোষ৷ কার বিরুদ্ধে কথা বলছে, যিনি বাংলাকে গর্বের আসনে বসিয়েছেন৷''
কিন্তু অমর্ত্য সেন নিজে দিলীপ ঘোষের মন্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ৷ তিনি বলেছেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ যা বলেছেন, তা নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই৷ ওঁর বলার নিশ্চয়ই অধিকার আছে৷ উনি যা ভেবেছেন, বুঝেছেন, সেটাই বলেছেন৷'' কবি শঙ্খ ঘোষও বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে নারাজ৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করাই অর্থহীন৷''
এই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে সুর বদলেছেন দিলীপ ঘোষ৷ বলেছেন, তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে চাননি, সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিজীবীদের কথা বলতে চেয়েছেন৷