নির্যাতিতার জন্য নারী ম্যাজিস্ট্রেটই কি সমাধান?
১৬ এপ্রিল ২০১৯মূখ্য হলো আইন, নারীর সম্মন ও গোপনীয়তা৷
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বা যৌন হয়রানির শিকার নারীর জবানবন্দি নেয়ার বিধান আছে৷ আইনে বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের অধীনে সংঘটিত কোনো অপরাধের তদন্তকারী কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা তদন্তকারী অন্য কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা ঘটনাটি নিজের চোখে দেখেছেন, এমন কোনো ব্যক্তির জবানবন্দি অপরাধের দ্রুত বিচারের স্বার্থে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অবিলম্বে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটকে ওই ব্যক্তির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার জন্য লিখিতভাবে বা অন্য কোনোভাবে অনুরোধ করতে পারবেন৷''
তবে আইনে জবানবন্দি নেয়ার ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা নেই৷ কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের ‘স্পেশাল কমিটি ফর জুডিশিয়াল রিফর্মস' জানতে পেরেছে পুরুষ ম্যাজিরষ্ট্রেটরাও জবাবন্দি নিচ্ছেন৷ তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদন প্রধান বিচারপতির কাছে উপন্থাপন করলে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্ট্রার জেনারেল মো. জাকির হোসেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি সোমবার ওই নির্দেশনা পাঠান৷
তাতে বলা হয়েছে, ‘‘একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নারী বা শিশু ভিকটিম ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিতে সঙ্কোচবোধ করেন৷ ফলে এরূপ নির্যাতনের শিকার শিশু বা নারী ঘটনার প্রকৃত বিবরণ দিতে অনেক সময় ইতস্তত বোধ করেন৷ এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক৷ এতে নারী ও শিশু ভিকটিমরা সহজে ও নিঃসঙ্কোচে তাঁদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারবে৷ এমতাস্থায়, সংঘটিত অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অর্পণের জন্য চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা গেল৷''
তবে সংশ্লিষ্ট জেলায় বা মহানগরীতে নারী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে অন্য কোনো যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেটকে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করে সুপ্রিম কোর্ট৷ এ নির্দেশনা অনুসরণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা বা অসুবিধা দেখা দিলে তা সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনারও অনুরোধ জানানো হয়েছে সার্কুলারে৷
‘নারী ম্যাজিস্ট্রেট সমাধান নয়'
মানবাধিকারকর্মী এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সুপ্রিমকোর্টের এই নির্দেশনার প্রতি সম্মান রেখেই বিষয়টি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাঁর জবানবন্দি নেয়া হবে তিনি একজন নির্যাতিত নারী৷ মূল কথা হলো, তাঁর যখন জবানবন্দি নেয়া হবে, তিনি যেন অস্বস্তি বোধ না করেন, আবার যেন নির্যাতনের শিকার না হন, তার গোপনীয়তা যেন রক্ষা করা হয়৷ আইন যখন তাঁকে নিয়ে কাজ করবে, তখন তাঁর মর্যাদা যেন রক্ষা করা হয়৷ তাঁর প্রতি অমর্যাদাকর কিছু যেন না হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এটা যদি আমরা নারী-পুরুষের বিষয়ে নিয়ে যাই, তাহলে অনেক নারী এখন তো নারীর হাতেই নির্যাতিত হচ্ছেন৷ নারীও দুর্ব্যবহার করছে নারীর সাথে৷ এটা তো গ্যারান্টি দেয়া যায় না যে, নারী হলেই সব নিয়ম-নীতি সে রক্ষা করবে৷'' তাঁর মতে, ‘‘পুরুষরা অনেক ব্যাপারে অসংবেদনশীল থাকেন, কিভাবে কথা বলবে সেটা তাঁদের জানা থাকে না৷ পুরুষ বলেই অনেক ব্যাপারে তাঁর মনোভঙ্গি ভিন্ন থাকে৷ সেসব দিক বিবেচনা করেই হয়তো আদালত এই এই নির্দেশ দিয়েছেন৷ কিন্তু এর একটা দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব আছে, যেটা হবে নারীকে নারী চিকিৎসক দেখবে, নারীকে নারী শিক্ষক পড়াবে, সেটা না করে যেটা করতে হবে, তা হলো, প্রত্যেক ব্যক্তি তিনি নারী বা পুরুষ যে-ই হোন, এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে নারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়৷ সেটা নিশ্চিত করা জরুরি৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ফেনীর নুসরাতের জবানবন্দি নেয়ার নামে ওসি যা করেছেন, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তিনি অপরাধ করেছেন৷ তার বিরুদ্ধেতে এখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷''
‘প্রয়োজন আইন সংস্কার'
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইনের মধ্যেই নারীকে অবমাননা এবং অপদস্থ করার ব্যবস্থা আছে৷ সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় একজন নারীর চরিত্র হননের সুযোগ দেয়া হয়েছে৷ নরীকে যদি দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করা যায়, তাহলে এই আইনে অভিযুক্ত পার পেয়ে যেতে পারেন৷ এখানেই নারীর চরিত্র হনন করার ব্যবস্থা রয়ে গেছে৷ ১৮৭২ সালের এই সাক্ষ্য আইন আমরা এখনো সংশোধন করিনি৷''
তিনি বলেন, ‘‘একজন নারী, যিনি নির্যাতনের শিকার হন, তাঁকে প্রতি পর্যায়ে অপমান অপদস্থের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ সেই মূল জায়গা আমরা ঠিক না করে আমরা এখানে একটা বাউন্ডারি বা লিমিট ক্রিয়েট করে দিচ্ছি যে, শুধুমাত্র নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়েই জবানবন্দি নিতে হবে৷ এটা না করে আমরা ১৮৭২ সালের আইনটি পরিবর্তন করতে পারি কিনা, সটা ভাবা উচিত৷ আর এটা হলো মাইন্ড সেটের ব্যাপার৷ এটা পেশাদরিত্বের প্রশ্ন৷ তিনি নারীও হতে পারেন পুরুষও হতে পারেন৷ কিন্তু আইনের যে ধারা আছে সেই ধারা অনুযায়ী জবাবন্দি নিতে হবে৷ যদি তাই হয়, তাহলে আইনে যা বলা আছে, সে বিষয়গুলো তো জানতে হবে৷ তাই আইনটা সংশোধন জরুরি৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘আমরা যদি এরকম ডিভিশন করে ফেলি, প্রত্যেক ক্ষেত্রে একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে জবাবন্দি নিতে হবে, থানায় একজন নারী কর্মর্তাকে মামলা নিতে হবে, একজন নারী ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, এই ট্রেন্ডটি যদি চালু হয়, তাহলে ট্যাবু থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না৷ নারীর অগ্রগতিতে এটা কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘নারীর মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করতে পারে৷ পুরুষের হাতে যেমন, তেমনি নারীর হাতেও নারী অ্যাবিউজ হতে পারে৷ তাই নারী পুরুষ আলাদা না করে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক সবাইকে পেশাদার হতে হবে৷ আইন হতে হবে নারীর প্রতি সংবেদনশীল৷ আর ভিকটিম নারীর ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়া যেতে পারে৷ তিনিই তাঁর নিজের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কার কাছে জবানবন্দি দেবেন৷''