‘নির্বাচনের আগে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন’
১৩ মে ২০২২২০১৮ সালেও নির্বাচনের আগে একই উদ্দেশ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) করা হয়েছিলো৷ এইসব আইন যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সুবিধার জন্য করা হয়৷ সাধারণ মানুষ এর শিকার হন৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত:
ডয়চে ভেলে: এপর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কী কী অপব্যবহার আপনারা দেখেছেন?
ফারুক ফয়সাল: আমরা এই আইনটি মনিটর করি৷ এটা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় কোনো কাজে আসে না৷ এটা সরকারি স্বার্থ বা যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহার করা হয়৷ আমাদের পর্যবেক্ষণ আমরা সরকারকে জানিয়েছি, জাতিসংঘকেও জানিয়েছি৷ এটা মানুষের মুক্ত মতপ্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখন সরকারও সেটা স্বীকার করছে যে এর অপব্যবহার হচ্ছে৷
ডয়চে ভেলে: এই আইনের কোনা ধারা বা বিধান মুক্ত মত প্রকাশের পথে বাধা?
ফারুক ফয়সাল: এই আইনের অতিরিক্ত অপব্যবহার হয়েছে৷ পুলিশকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷ কোথাও কোথাও জামিন অযোগ্য করা হয়েছে৷ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷ তল্লাশির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷ যেমন ধরুন মানহানি৷ এর কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ ফলে এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে৷
ডয়চে ভেলে: নতুন ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্টকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ফারুক ফয়সাল: আইসিটি অ্যাক্ট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হলো৷ তাতে যা হলো পুরনো আইনে যা বিস্তারিত ছিল না নতুন আইনে তা আরো বিস্তৃত করা হলো৷ আর আইনটি করা হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে৷ তাই ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, আমরাও তাই আবার ভয় পাচ্ছি৷ কারণ সামনে আবার জাতীয় নির্বাচন৷ শুধু বিটিআরসির ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট নয়, রেগুলেশন ফর ডিজিটাল,সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা- এই সবগুলোর মধ্যেই বলা হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় এইসব আইন করা হচ্ছে৷ পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্টকারী, ধর্মীয় চেতনায় আঘাতকারী, দেশীয় সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কোনো কনটেন্ট আপ করা যাবে না৷ কিন্তু সমস্যা হলো এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ এর ফলে যা হবে এটা ইচ্ছে মত ব্যবহার করা হবে৷ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হবে৷ বাক স্বাধীনতা, মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে৷ যেটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়েছে৷ সব মিলিয়ে সরকার একটি কঠোর নিয়ন্ত্রণের দিকে যাচ্ছে৷
ডয়চে ভেলে: ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা কীভাবে হরণ করবে?
ফারুক ফয়সাল: আইনটি যখন হবে তখন কোনো নাগরিকই নিরাপদ থাকবেন না৷ তার ব্যক্তিগত যে তথ্য তার সংরক্ষণে থাকবে সেটা অন্যে হাতে চলে যাবে৷ সরকার যদি মনে করে সেটা অন্য কোনো দেশকে দিতে হবে, দিয়ে দিতে পারবে৷ ধরুন ইউক্রেন যুদ্ধ৷ সেখানে আমি রাশিয়ার পক্ষে নই৷ ফেসবুকে আমার যে কনটেন্ট আছে৷ আমি ফেসবুকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে (ইনবক্স) যা বলছি তা সরকারের হাতে চলে যাবে৷ সরকার চাইলে তা রাশিয়াকে দিতে পারবে৷ আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে৷ এটা আমার যেকোনো তথ্যের ব্যাপারেই হতে পারে৷ আমার ভয় হচ্ছে অপব্যবহারের জায়গায়৷
ডয়চে ভেলে: আলাদাভাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে শঙ্কার কারণ কী?
ফারুক ফয়সাল: শিল্পের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে৷ আমার চিন্তার ভিন্নতা, আমার মতের ভিন্নতা বা নতুন ধরনের চিন্তা কারো কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে৷ কিন্তু আইনে তো সেটা আটকে দেয়া যাবে৷ আর আইনে বলা হয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে তথ্যভান্ডার স্থাপন করতে হবে৷ তাহলে তো পুরোটাই সরকারের হাতে চলে যাবে৷ এই যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা এটা শিল্পের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা অনবরত বিঘ্নিত করবে৷
ডয়চে ভেলে: তাহলে সব মিলিয়ে এই আইনগুলোর টার্গেট কী?
ফারুক ফয়সাল: সরকার যখনই মনে করে নির্বাচনে জেতার জন্য মানুষের মতকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তখনই এই আইনগুলো তৈরি করে৷ ডাটা প্রটেকশন তো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা৷ এখানে তো উল্টোটা হচ্ছে৷ এখানো তো কোনো প্রটেকশনই নাই৷ অন্যান্য দেশে যে ডাটা প্রটেকশন আইন নেই তা নয়৷ কিন্তু তারা মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী যতদূর সম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু এটা রক্ষা না করা হলে স্বাধীন দেশে আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে৷ ফিজিক্যাল নিরাপত্তার মতই নাগরিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা প্রয়োজন৷ তার জন্য যে আইন দরকার তা আমরা দেখছি না৷
ডয়চে ভেলে: সাধারণ মানুষের তো জিজিটাল, সাইবার নিরাপত্তা প্রয়োজন৷ সেটা তারা কীভাবে পাবে?
ফারুক ফয়সাল: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে রিজার্ভ চুরি হয়ে গেছে সেই তথ্য আমার জানা দরকার৷ বিকাশ থেকে যে জালিয়াতি হয় সেটা আমার জানা দরকার৷ আপনি যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তাহলে আপনাকে আগে আমার নিরাপত্তা দেখতে হবে৷ আপনার দলের, আপনার সরকারের, আপনার লোকজনের নিরাপত্তা, কর্তৃত্বই যদি প্রাধান্য পায় আমার নিরাপত্তার চেয়ে তাহলে তো হলো না৷ আমাকে বিব্রত করা বা আমাকে অনিরাপদ করার জন্য তো আমি আপনাকে ভোট দিয়ে বা না নিয়ে ক্ষমতায় আনি নাই৷