জার্মানির অরণ্য ঘিরে গোপন ইতিহাস
২ সেপ্টেম্বর ২০১৮কল্পকাহিনির দিক দিয়ে জার্মানিতে রাইনহার্ডসভাল্ড সবচেয়ে বেশি আলোচিত৷ ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথের কেন্দ্রস্থলের এই অরণ্য এক সময় রূপকথার বুড়ি, রাজকন্যা ও অপদেবতার ‘উপস্থিতির' জন্য বিখ্যাত ছিল৷
কথিত আছে রাইনহার্ডসভাল্ডের কাছে এক সাহসী রাজকন্যার দীর্ঘ ঘুম ভাঙে ভালোবাসাপূর্ণ প্রথম চুমুতে৷ এরপর রাপুনজেল একটি টাওয়ার থেকে তাঁর দীর্ঘ সোনালি কেশ ঝুলিয়ে দেন যেন প্রেমিক তা ধরে উঠে তাঁর কাছে আসতে পারে৷
প্রকৃতপক্ষে এটাই এক সময়ের সেই গভীর জঙ্গল, যা গ্রিম ভাইদের সংগ্রহ করা অনেক রূপকথায় উঠে এসেছে৷ তাঁদের এই কাজের মধ্য দিয়ে জার্মানরা তাঁদের কল্পজগতে ওই বনের নানা চিত্র এঁকেছেন৷
কোনো এক সময় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুখে মুখে চলে আসা লোককাহিনিগুলো লিখেছিলেন গ্রিম ভাইয়েরা৷ কোনো রাজকন্যার ১০০ বছর ঘুমিয়ে থাকা প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব৷ এই গল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো– একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অশুভ বাগান সব ধরনের বিপদের কারখানা৷
হেনৎসেল ও গ্রেটেলের গল্পে অভাগা সহোদর বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যায়৷ সেখানে তাঁদের একটি মানুষখেকো ডাকিনীর মুখোমুখি হতে হয়৷
রাইনহার্ডসভাল্ড পার্কের ব্যবস্থাপক এরিক আশেনব্রান্ড বলেন, এই ডাকিনী মূলত জঙ্গলে বিপদের প্রতিরূপ৷ তবে ওই শিশুরা বিপদমুক্ত হয়ে খুশি মনেই বন থেকে বেরোয়৷
গল্পে জনমানবহীন এই বন বিস্ময়কর নানা চ্যালেঞ্জের রাজ্য৷বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জঙ্গল ছিল বন্য প্রাণীতে ভরা এবং সেখানে কিছু ওঁত পেতে থাকতে পারে বলে দীর্ঘদিনের শঙ্কা ছিল মানুষের মধ্যে৷
বন ধ্বংসের শুরু
মধ্যযুগে বনকে অশুভ কিছুর আধার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও একে অফুরন্ত কাঠ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎস হিসেবে দেখা হতো৷
সতেরো শতকের শুরু ও আঠারো শতকের বারোক শিল্প যুগের আগ পর্যন্ত বন নিয়ে মানুষের ধারণা এমনই ছিল৷
এই পর্বে দ্রুত নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে৷ প্রাসাদ ও দুর্গগুলো আরো বড় পরিসরে ও জাঁকালো করে গড়ে তোলা হয়৷ ব্যবসায়ী ও কাঠ খোদাই শিল্পীরা তাঁদের সম্পদ বাড়াতে থাকেন আর তাঁদের প্রয়োজনীয় উপকরণ আসতে থাকে বন থেকে৷
আঠারো শতকে ঘরের কড়িকাঠ, জাহাজের মাস্তুল নির্মাণ এবং জ্বালানি হিসেবে বছরে এক কোটি ঘনফুটের মতো কাঠ ব্যবহার হতো৷ জ্বালানি হিসেবে কাঠের উপর ভর করেই প্রথম শিল্প উদ্যোগের শুরু৷
এর ফলশ্রুতিতে বনজঙ্গল কমতে থাকে, বিশেষত শহর ও বাণিজ্যিক এলাকার আশপাশে৷
তবে মানচিত্র থেকে বনভূমি কমার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানদের কল্পনায় সংস্কৃতি, সংগীত, চিত্রকলা ও সাহিত্যে তার উপস্থিতি বাড়তে থাকে৷
ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে গ্রিম ভাইদের মতো রোমান্টিকতায় অনুপ্রাণিত লেখকদের লেখায় প্রকৃতি প্রেম উঠে আসে৷ বন এবং সেখানে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের প্রশংসা করেন তাঁরা৷
গাছ ও বনের ছবির জন্য বিখ্যাত কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিশের মতো ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্টরা বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন৷
উজাড় হওয়া বন ফিরে পেতে বনায়ন প্রকল্প শুরু করে জার্মানি৷ সে সময় ফরেস্ট্রি একটি স্বপ্নের পেশায় পরিণত হয় বলে জানান সাউদার্ন জার্মানির ফ্রাইবুর্গ ইউনিভার্সিটির ফরেস্ট হিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক উভে স্মিট৷
তাঁর ভাষ্য মতে, সে সময় অনেক নারীর কাছে স্বামী হিসেবে ফরেস্টার কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠেন৷ তখন লৈঙ্গিক কারণে এ পেশায় যেতে পারতেন না নারীরা৷
এই শতকেই গোলযোগপূর্ণ শিল্প নগরী থেকে নির্জন প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে বনে যাওয়া শুরু করেন অনেকে৷
‘‘এখনো সেটা চলছে,'' বলেন রাইনহার্ডসভাল্ডের ব্যবস্থাপক আশেনব্রান্ড৷
তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃতি নিয়ে নগরের বাসিন্দাদের ধারণা এখানকার অধিবাসীদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ তাঁরা বনকে দেখেন তাঁদের শহরের বিপরীত হিসেবে৷''
বনের কালো অধ্যায়ে ফেরা
বিশ শতকে জার্মানি ফ্যাসিবাদের দিকে ঝোঁকায় বনের সঙ্গে যোগাযোগকে আবার খারাপ হিসেবে দেখা শুরু হয়৷
নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পর জার্মান বনজঙ্গল ঘিরে লৌকিক কাহিনিগুলোকে কাজে লাগাতে থাকে৷ ‘‘ন্যাশনাল সোশ্যালিজমের (নাৎসিবাদ) সময় বনকে নেওয়া হলো মতবাদে,'' বলেন অধ্যাপক স্মিট৷ তাদের মতবাদ অনুযায়ী, বনের সঙ্গে জার্মানদের নিবিড় সম্পর্কের কারণেই এ বিষয়ে এভাবে রূপকথা তৈরি হয়েছে৷
নাৎসিরা বলে, হ্যারমানের নেতৃত্বে জার্মান গোষ্ঠীগুলো বনের মধ্যেই রোমান সৈন্যবাহিনীকে কচুকাটা করে৷ আর তার কারণেই রাইন নদীর পূবের ভূমি দখলের পরিকল্পনা ত্যাগ করে রোম৷
জার্মান বন ও জনগণ এক ও অভিন্ন বলে নতুন পৌরাণিক তত্ত্ব দাঁড় করায় তারা৷ এই ভাবনাই তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে অনিচ্ছুক গোষ্ঠীগুলোকে জার্মানির জাতীয় ঐক্য থেকে বাদ দিতে সহায়তা করে৷
অধ্যাপক স্মিট বলেন, এই মতবাদের মাধ্যমেই ছড়ানো হয় যে, ইহুদিরা তৃণভূমিকেন্দ্রিক এবং তাঁরা জার্মানির বনের সংস্কৃতি বুঝতে অক্ষম৷
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বন আবার জার্মানদের কাছে শান্তির জায়গা হয়ে ওঠে৷
‘বোমায় ক্ষতবিক্ষত শহরগুলোর তুলনায় বন দ্রুত বাড়ে৷ আর গাছের নীচে বসেই মানুষ অন্তত কিছু সময়ের জন্য সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ ভুলে থাকতে পারত৷
‘সমাজের আয়না'
তখন থেকে বন হয়ে উঠেছে সম্পদের ভাণ্ডার৷ আশির দশকে অ্যাসিড বৃষ্টিতে অবশিষ্ট বন ধ্বংসের পথে থাকার বিষয়টি যখন জার্মানদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে, সে সময় পরিবেশ আন্দোলনকারীদের কাছে তা একটি ‘পোস্টার চাইল্ড' হয়ে ওঠে৷
ওই উদ্বেগই জার্মানদের আরো বেশি পরিবেশসচেতন এবং প্রাচুর্যময় জীবনযাপনের পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি এনে দেয় বলে মন্তব্য করেন স্মিট৷
তিনি বলেন, গত দুই-তিন দশকেও জার্মানিতে বনকে কীভাবে দেখা হয়েছে, সে দিকে দৃষ্টি দিলে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র উঠে আসবে৷
জার্মানিতে বন সব সময় ‘সমাজের জন্য দর্পণ' এবং উদ্বেগের একটি বিষয় হয়ে ছিল বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকরা৷
ক্লাউস এসলারলুস/এএইচ