নাৎসি সন্ধান
২৭ জুলাই ২০১৩‘‘আমরা ৬০ জনের কথা বলছি৷ তাদের সবাই দিনের পর দিন গণহত্যার সাথে জড়িত ছিল৷'' কথাগুলো বলছিলেন জেরুসালেমে কর্মরত সিমন-ভিজেনথাল সেন্টার-এর প্রধান এফরাইম সুরফ৷ তিনি আরও বলেন, ‘‘তাদের জন্ম হয়ত ১৯১৯, ১৯২০ কিংবা ১৯২১ সালে হতে পারে৷ কিন্তু শুধু বয়সের কারণে তাদের অপরাধের ব্যাপারটি খতিয়ে না দেখার কোনো কারণ থাকতে পারে না৷''
‘‘সিমন-ভিজেনথাল সেন্টার মূলত হলোকস্ট তথা ইহুদি নিধনযজ্ঞের ঘটনা তদন্তের কাজ করে৷ তবে যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেও অসাধারণ সাফল্যের জন্য তারা সুপরিচিত৷ এখন তারা ‘অপারেশন লাস্ট চান্স' নামে একটি আন্দোলন চালাচ্ছে৷ এই অভিযানের লক্ষ্য জার্মানিতে গা ঢাকা দিয়ে থাকা নাৎসি বাহিনীর সর্বশেষ সদস্যদের খুঁজে বের করা এবং বিচারের সম্মুখীন করা৷
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) বার্লিন, কোলন এবং হামবুর্গ শহর থেকে শুরু হয় এই অভিযান৷ চলবে দুই সপ্তাহ ধরে৷ ২০০০ বড়সড় পোস্টার টাঙিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে৷ এতে জনগণকেও সাহায্যের আহ্বান জানানো হয়েছে৷
এই অভিযানের মধ্য দিয়ে প্রথমত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে কর্মরত প্রহরীদের খুঁজে বের করা হবে৷ এছাড়া কুখ্যাত এসএস নামের বিশেষ বাহিনীর সদস্যদেরকেও চিহ্নিত করা হবে৷ সুরফের হিসাব অনুসারে, সেই ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৬০০০ জনকে নিযুক্ত করা হয়েছিল৷ তাঁদের অধিকাংশই ছিল পুরুষ৷ এঁদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ হয়ত ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন৷ বাকিদের অর্ধেক অতিবৃদ্ধ এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে অপারগ হতে পারে৷ তবুও বাকি থাকে আরও অন্তত ৬০ জন৷ তবে সুরফের মতে, বেঁচে থাকা নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে৷ যদিও এর সঠিক সংখ্যা আসলে কেউ জানে না৷
তথ্য দিলে ২৫০০০ ইউরো
এই ধরনের ক্যাম্পেইনে প্রেরণা এসেছে জন দেমইয়ানুকের বিচারের রায় থেকে৷ তার আসল নাম অবশ্য ইভান দেমইয়ানুক৷ মিউনিখ শহরের আদালতে দুই বছর আগে তার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় হয়৷ তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত মনে করে যে, দেমইয়ানুক নিধনশিবির ‘সবিবর-এ' পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো৷ ফলে সেখানকার হত্যাযজ্ঞের সাথে তার জড়িত থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি৷ এটাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার ব্যাপারে যথেষ্ট৷ জার্মান আদালতে সন্দেহভাজন নাৎসি যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা থেমে গেছে৷ কারণ হত্যা ও নির্যাতনের সাথে এককভাবে তার সম্পৃক্তি প্রমাণ করা সম্ভব ছিল না৷
ইতিমধ্যে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে৷ নষ্ট হয়েছে প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণ৷ মারা গেছেন অসংখ্য সাক্ষী৷ তবুও আইনি প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন করে মিউনিখের আদালত একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে৷ এর ফলে আরও কিছু নাৎসি খুনিকে বিচারের আওতায় আনা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন সুরফ৷ যদিও সাক্ষ্য-প্রমাণ দাঁড় করানোটা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি৷ তাই পোস্টার-প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে মানুষের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে৷ ‘‘আমরা বলছি, নাৎসি অপরাধীদের হাতে লাখ লাখ মানুষ খুন হয়েছে৷ তাই এই অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে আমাদের সাহায্য করুন৷ আমরা প্রত্যেকটি তথ্যের জন্য ২৫০০০ ইউরো পর্যন্ত পুরস্কার দেবো৷''
ষাটের দশকের ধারাবাহিকতা
সিমন-ভিজেনথাল সেন্টার-এর অভিযোগের সাথে একমত পোষণ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর এমেরিটাস ইয়োয়াখিম পেরেলস৷ তিনিও মনে করেন যে, জার্মান বিচার বিভাগ দীর্ঘদিন নাৎসি অপরাধকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানতে চায়নি৷ পেরেলস বলেন, ‘‘জার্মানিতে মাত্র ১৬০ জন নাৎসি অপরাধীর সাজা হয়েছে৷ অথচ ইহুদি, সিনটি ও রোমা গোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষ খুন হয়েছিল এবং যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করেছিল৷ সেই তুলনায় অপরাধীদের সাজাপ্রাপ্তির সংখ্যা মোটেও সন্তোষজনক নয়৷''
এর কারণ হিসাবে মনে করা হয়, ‘জার্মান বিচার ব্যবস্থায় নাৎসি আমলের ধারাবাহিকতা'৷ পেরেলস বলেন, ‘‘৫০ ও ৬০-এর দশকে জার্মান বিচার বিভাগের তিন চতুর্থাংশ বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টরা জাতীয় সমাজতান্ত্রিকদের সময়ে বিভিন্ন আদালতে কর্মরত ছিলেন৷'' এ কারণে যুদ্ধের কয়েক দশক পরেও ‘মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত' আসছে৷
সময় ফুরিয়ে আসছে
মিউনিখের আদালত দেমইয়ানুকের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, বিগত বছরগুলিতে জার্মান বিচার ব্যবস্থা অনেক পাল্টেছে৷ তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পেরেলস এবং নাৎসি বিরোধী ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তা সুরফ উভয়ই একমত যে, জার্মান বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতার পর এখন সময় খুবই কম৷ আর এ জন্য সর্বশেষ নাৎসি অপরাধীদের চিহ্নিত করার কাজ দ্রুততর করতে হবে৷