নাবালিকা স্ত্রীকে সম্ভোগ কি ধর্ষণ?
২০ আগস্ট ২০১৭গত সপ্তাহে মোদী সরকার ধর্ষণ সংক্রান্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ (২) ধারাটি সমর্থন করে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের আর্জি জানিয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট ঐ ধারায় বলা হয়, কোনো ব্যক্তি যদি তার ১৫ থেকে ১৭ বছরের, অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্কা বিবাহিত স্ত্রীকে জোর করে যৌনমিলনে বাধ্য করে, তবেও সেটা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না৷ কারণ ভারতীয় সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা এর সঙ্গে জড়িত৷ জড়িত ধর্মীয় সংস্কার৷
এর মানে এই যে, স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করলেও ভারতীয় সংস্কৃতি ও সংস্কারের প্রেক্ষিতে তা মেনে নিতে হবে৷ ‘ইন্ডিপেনডেন্ট থট' নামে এক এনজিও-র দাখিল করা জনস্বার্থ মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী বিনু টামটা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এম বি লোকুরের এজলাসে এই মর্মে বক্তব্য পেশ করে বলেছেন, মেয়েটির বয়স যদি ১৮ বছরের নীচে হয়, তাহলেও সেটা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না৷ বরং ঘটনাটিকে গণ্য করতে হবে ব্যতিক্রম হিসেবে৷ নাবালিকার বিবাহ পরিহারযোগ্য৷ কিন্তু ভারতীয় সমাজের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে সেটা নাকি বন্ধ করা সম্ভব নয়৷ সুতরাং সেটা গ্রহণযোগ্য৷
সরকারের হিসেব অনুযায়ী, ভারতে নাবালিকা স্ত্রীর সংখ্যা ২ কোটি ৩০ লক্ষের মতো৷ আদালতের রায় যদি ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ঐ সব নাবালিকাদের স্বামীর শাস্তি হতে পারে৷ বলা বাহুল্য সেক্ষেত্রে ঐ সব মেয়েদের জীবন আরও দুর্বিষহ হোয়ে উঠবে৷ ঐ এনজিও-র আইনজীবী গৌরব আগরওয়াল এর জবাবে বলেন, ভারতে ১৮ বছরের একটি মেয়ে সাবালিকা বলে গণ্য হয়৷ সেই মেয়ের বিয়েই আইনত গ্রাহ্য৷ স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনের ক্ষেত্রেও সেটা প্রয়োজ্য৷ মেয়ের বয়স এর নীচে হলে সেই বিবাহ আইনত অবৈধ৷ এমনকি নাবালিকা স্ত্রীর সম্মতিতেও পুরুষ ও মেয়ের যৌন মিলন আইনত অপরাধ৷ সরকারের আর্জি খারিজ না করলে আদালতের রায়ে বাল্য বিবাহকেই সমর্থন করা হবে৷ তাই ধর্ষণ সংক্রান্ত বর্তমান ধারাটির সংশোধন জরুরি৷ কারণ এ ধারায় বলা হয়েছে, নাবালিকা স্ত্রীর ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলন অপরাধ নয়৷ মেয়ের বয়স ১৮ বা তার বেশি হলে স্বামীর সঙ্গে সহবাস যেমন গ্রাহ্য, সেই একই নিয়ম ১৮ বছরের নীচে বিবাহিতা মেয়ের ক্ষেত্রেও ঐ একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিত৷ উল্লেখ্য, বর্তমান আইনে ১৮ বছরের নীচে একটি মেয়ে নাবালিকা৷ কিন্তু বিয়ে হলেই সে সাবালিকা হয়ে যাবে৷ এটা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত হতে পারে? হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গ্রুপের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান মীনাক্ষী গাঙ্গুলির মতে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণে নাবালিকা স্ত্রীকে ধর্ষণ অবৈধ না বলাটাও সরকারের দিক থেকে অপরাধ৷ সরকারের এই বার্তা ভারতের লিগ্যাল সিস্টেমকে আঘাত করতে পারে৷
বিষয়টির সামাজিক এবং আইনি দু'টো দিকই আছে৷ কাজেই খুঁটিয়ে পরীক্ষা না করে রায় দেওয়া যাবে না৷ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এম বি লোকুরে তাই সরকারি আইনজীবীকে বাল্য বিবাহ এবং বাল্য বিবাহ নিবারক অফিসারদের পরিসংখ্যান দাখিল করতে বলেছেন৷ ২০০৬ সালের বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইনে কতগুলি মামলা দায়ের করা হয়েছে, তাও জানতে চেয়েছেন তিনি৷ বাল্য বিবাহ আটকাতে না পারলে সেটা সরকারের ভূমিকার ওপর প্রশ্নচিহ্ন খাড়া করবে৷ আদালত অবশ্য ওয়াকিবহাল যে ভারতে আকছার বাল্য বিবাহ, অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে৷ এছাড়া নাবালিকা মেয়ে, যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর, তাদের কী রকম দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে, সেটাও বিশদভাবে পরীক্ষা করা দরকার, বলেছে আদালত৷ শুধু আইন করে তা সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না৷ পাশাপাশি দরকার সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলন৷
সমাজের হালহকিকত হলো, স্ত্রী মানেই যেন স্বামীর সম্পত্তি৷ স্বামীর যৌনপুতুল সর্বস্ব৷ সে শিক্ষিতা হোক বা অশিক্ষিতা৷ নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা, অধিকার, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সব যেন ভেসে গেছে পুরুষতান্ত্রিকতায়৷ এমনও দেখা গেছে যে, গর্ভবতী স্ত্রীকে সম্ভোগ করতে গিয়ে গর্ভপাত পর্যন্ত হয়েছে৷ কিন্তু তাতে কী? দেহসুখই যে আগে! আর এই নিয়ে কারও কাছে নালিশ জানাবার সুযোগ পর্যন্ত নেই সংসারে, সমাজে৷ বাড়িতে কাউকে এ বিষয়ে বলতে গেলে আজও শুধু টিটকারি শুনতে হয় নারীদের৷ দৈহিক নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে কেউ সাহস করে পুলিশের কাছে গেলে বাড়ে বিড়ম্বনা৷ বিস্ফারিত চোখে পুলিশ জিজ্ঞাসা করে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর ধর্ষণের অভিযোগ? সে কী কথা?
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷