নাইকো মামলায় সাক্ষ্য দেবে এফবিআই ও ক্যানাডার পুলিশ?
২৩ নভেম্বর ২০১৮এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় অনির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম৷ সেখানে তিনি বলেন, নাইকো দুর্নীতি মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (এফবিআই) ও ক্যানাডিয়ান পুলিশের পৃথক দু'টি প্রতিবেদন তাঁদের হাতে এসেছে৷
মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘আজকে (বৃহস্পতিবার) আমি আমাদের বিশেষ জজ আদালত-৯-এ সেই প্রতিবেদনগুলো দাখিল করে একটি আবেদন করেছি যে, ক্যানাডার মাইন্টেড পুলিশের এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের তদন্তকারীরা যাতে এ দেশে এসে তাদের পাঠানো প্রতিবেদনের স্বপক্ষে আদালতে বক্তব্য পেশ করতে পারেন৷ আমার এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৯ ডিসেম্বর শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে৷''
উল্লেখ্য, ক্যানাডাভিত্তিক তেল ও গ্যাস উৎপাদন কোম্পানি নাইকো রিসোর্সের বিপক্ষে দেশটির ক্যালগারির একটি আদালতে বাংলাদেশের একজন প্রতিমন্ত্রীকে ঘুস দেয়ার অভিযোগ ২০১১ সালের জুন মাসে প্রমাণিত হয়৷ তখন রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীকে অর্থ ও একটি এসইউভি গাড়ি এবং ক্যালগারি ও নিউইয়র্কে ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে নাইকো৷ নাইকোকে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানাও করা হয়৷
পূর্ব ও পশ্চিম ছাতক গ্যাসফিল্ড নিয়েই মূলত বিতর্ক৷ পশ্চিম ছাতক গ্যাসফিল্ড পরিত্যক্ত হলেও পূর্ব ছাতক আলাদা গ্যাসফিল্ড ছিল, এবং এতে এখনো পর্যন্ত কোনো ড্রিলিং হয়নি৷ কিন্তু তখন অস্বচ্ছ এক চুক্তিতে নাইকোকে দু'টো গ্যাসফিল্ডই পরিত্যক্ত হিসেবে কম দামে দিয়ে দেয়া হয়৷
জনাব আলম বলেন, ‘‘ক্যানাডায় নিবন্ধিত নাইকো নামে একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের কয়েকটি গ্যাস ফিল্ড লিজ নেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল৷ ২০০২ সাল পর্যন্ত পূর্ব ছাতক গ্যাস ফিল্ড একটি ভার্জিন গ্যাস ফিল্ড অর্থাৎ গ্যাসে পূর্ণ ছিল বলে বাপেক্স এবং আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অভিমত দিয়েছিল৷ কিন্তু নাইকো নানা অসৎ পন্থা অবলম্বন করে আমাদের দেশের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে হাওয়া ভবনকে প্রভাবিত করে এই পূর্ব ছাতক গ্যাস ফিল্ডটি লিজ নেয় এবং একটি পরিত্যক্ত গ্যাস ফিল্ড হিসেবে এটাকে তখন তাদের হাতে দেওয়া হয়৷ আসলে এই গ্যাস ফিল্ড কখনো পরিত্যক্ত ছিল না৷''
পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি মামলা করে৷ দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলাটি করেন৷ এরপর ২০০৮ সালের ৫ই মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন দুদকের সহকারী পরিচালক এস এম সাহেদুর রহমান৷ অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়৷
মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘পূর্ব ছাতকের গ্যাস ফিল্ড নেওয়ার ব্যাপারে তারা (নাইকো) যে ঘুষ প্রদান করে, তা নিয়ে ক্যানাডার রয়েল মাউন্টেড পুলিশ ২০০৫ সালে তদন্ত শুরু করে এবং তারা তদন্তে প্রমাণ পায়, এই নাইকো তাদের দেশ (ক্যানাডা) থেকে টাকা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশ হয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল এবং কয়েকজন ব্যক্তিকে ঘুষ দিয়েছিল৷''
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এসব প্রতিবেদনে যাদের নাম রয়েছে- তারা হলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এ কে এম মোশাররফ হোসেন, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, খন্দকার শহিদুল ইসলাম, কাশেম শরীফ, সি এম ইউসুফ হোসেন, সেলিম ভূঁইয়া, গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, মীর মঈনুল হক এবং এম ডি শফিউর রহমান৷ এই প্রতিবেদনে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের নাম এসেছে এভাবে যে, তিনি তারেক রহমানের বন্ধু ছিলেন, তার প্রভূত ক্ষমতা ছিল এবং তার মাধ্যমেই এই লেনদেন হয়েছে৷
এদিকে, বিষয়টিকে রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে কালার দিতেই নির্বাচনের ঠিক আগমুহুর্তে এটা নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল রাজনীতি করছেন৷ এফবিআই'র কে তদন্ত করেছে? একজন এজেন্ট? সে কিভাবে এখন আদালতে স্বাক্ষ্য দেবে? এই মামলার তদন্ত হয়েছে, চার্জশিট হয়েছে, এখন বিচার চলছে৷ হঠাৎ করে একজন এসে বলল, আমি স্বাক্ষ্য দিতে চাই, তাই বলে আপনি তার স্বাক্ষ্য নেবেন? কোন আইনের বলে এটা আপনি নেবেন?''
ক্যানাডা পুলিশ এবং এফবিআইয়ের প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘২০১৭ সালে আমি ক্যানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম তদন্ত করে তারা যে তথ্য পেয়েছেন সেগুলো আমাদের পাঠাতে৷ তারা এ অনুরোধে সাড়া দিয়ে ‘মিউচ্যুয়াল অ্যাসিস্টেন্স'-এর আওতায় প্রতিবেদনগুলো আমাদের পাঠিয়েছেন৷'' প্রতিবেদন দুটির বিষয়ে মাহবুবে আলম জানান, প্রতিবেদনগুলো ৭/৮ পৃষ্ঠার৷ ক্যানাডার মাইন্টেড পুলিশ তদন্ত করে যা পেয়েছে তার একটি প্রতিবেদন এবং এফবিআইয়ের বিশেষ প্রতিনিধিরা তদন্ত করে যা পেয়েছে, তারও একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে৷
এসব প্রতিবেদনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম আছে কিনা তা জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘এসব প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর নাম নেই, কেননা, ঘটনার সূত্রপাত ২০০২ সালের পরে৷''
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলা চলমান থাকা অবস্থায় অ্যাটর্নি জেনারেল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বেআইনি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত৷ জনাব খোকন অভিযোগ করেন, ‘‘আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন অনুসারে নিজস্ব পাবলিক প্রসিকিউটরের (রাষ্ট্রপরে আইনজীবী) মাধ্যমে দুদকের মামলা পরিচালনার নিয়ম থাকা সত্ত্বেও, অ্যাটর্নি জেনারেল বারবার নাইকো মামলা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে মামলাটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন৷ তাঁর এ ধরনের বক্তব্য বেআইনি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত৷''
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী বলেন, ‘‘মূলত শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে নাইকোর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়া তাঁর সরকারের আমলে ফাইলটির অনুমোদন দিয়েছিলেন৷ তাই ক্যানাডিয়ান পুলিশ ও এফবিআই এর প্রতিবেদন একপেশে৷ এমনকি এই মামলা নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলও একপেশে বক্তব্য রাখছেন৷''
ব্যারিস্টার খোকন দাবি করেন, নাইকো মামলা চলাকালীন এর তদন্ত প্রতিবেদনে এবং সাক্ষীর তালিকায় ক্যানাডা পুলিশ কিংবা এফবিআই কর্মকর্তাদের নাম না থাকা সত্ত্বেও দেশে এনে তাদের তৈরি করা তদন্ত প্রতিবেদনের পক্ষে বক্তব্য দিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে যে আবেদন করেছেন সেটি আইনসম্মত নয়৷ সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়ার সুনাম নষ্ট করতে এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন করছে বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী৷