নদী রক্ষা কমিশন : নদী ‘কমায়’, দখলদার বাড়ায়
২ জুন ২০২৩দখলদারের তালিকার বাইরে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের আওয়তায় ৪৮টি নদীর ৩৮ হাজার অবৈধ স্থাপনা ও দখলদারদের তালিকাও তৈরি করা হয়৷ কিন্তু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সেই তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পর তালিকাটা সরানোর সিদ্ধান্ত হয়৷ এই প্রকল্পে ২৯ কোটি টাকা খরচ করা হলেও কাজ কতটা হয়েছে, সুফল কতটা পাওয়া যাবে সে প্রশ্ন রয়েছে৷
এই প্রকল্পের সমীক্ষায় সবচেয়ে বেশি চার হাজার ৭০৭টি স্থাপনা পাওয়া যায় কীর্তনখোলা নদীতে৷ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পাওয়া গেছে দুই হাজার ৪৯৩টি স্থাপনা, ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ৮৯৪টি, ধলেশ্বরীতে ৮৮৬টি, তুরাগ নদে ৬৬১টি এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪৬৮টি অবৈধ স্থাপনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে৷ এছাড়া করতোয়ায় ৮০৭, কক্সবাজারের বাঁকখালীতে ২১৮, গোমতীতে দুই হাজার ১২০টি, পার্বত্য জেলার সাঙ্গুতে ৩৩৩ স্থাপনাসহ আরো কিছু নদীতে অবৈধ স্থাপনার তালিকা করা হয়৷
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এটা আসলে আরো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হবে৷ তার আগে প্রকাশ করা ঠিক হবে না৷ এখন আমরা সিএস দাগ ধরে তালিকা করছি৷’’
তবে সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদার মনে করেন, ‘‘এই তালিকা ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া ঠিক করা হয়নি৷ এতে দখলদাররা উৎসাহিত হয়, দখল আরো বেড়ে যায়৷ আমরা প্রথম দুটি তালিকা করার পর প্রকল্পের আওতায় সুনির্দিষ্ট ৪৮টি নদীর দখলদার চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে এসেছিলাম৷’’
তার কথা, ‘‘এই তালিকা প্রকাশের ম্যান্ডেট কমিশনের আছে, আদালতই আদেশ দিয়েছেন প্রকাশ করতে৷ আর আইন না বুঝলে এবং কমিশনের মধ্যে অসততা থাকলে এমন হয়৷’’
নদী ও দখলের সার্বিক চিত্র
নদী রক্ষা কমিশন বলছে, দেশে এখন দেশে প্রকৃতপক্ষে ৮৫৭টি নদী আছে৷ তবে তারা আরো যাচাইবাছাই করে তালিকা ওয়েব সাইটে প্রকাশ করবে৷ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৯ সালে হাইকোর্টের আদেশে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রথম তালিকা তৈরি করে৷ ওই তালিকায় নদীর দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০ জন৷ এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে, যা মোট নদী দখলকারীর ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ৷ ২০২০ সালের তালিকায় দখলদার বেড়ে হয় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন৷ তবে ওই তালিকায় সব জেলার তথ্য তখন পাওয়া যায়নি৷ এরপর আর তালিকা নিয়ে কাজ হয়নি৷ উল্টো তালিকা নিয়ে নানা কাহিনি চলছে৷
২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদকে ওই তালিকার তথ্যই জানিয়ে বলেন, তালিকা ধরে উচ্ছেদ অভিযান চলছে ৷ তিনি সংসদকে জানান, তখন পর্যন্ত নদী তীরবর্তী ২১ হাজার ৪৪৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে ৭২৩.৬২ একর জমি৷
এর মধ্যে ঢাকা নদী বন্দরে ১৬ হাজার ৪২৪টি, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে চার হাজার ৭৬৯টি, বরিশাল নদী বন্দরে ১৪১টি, আশুগঞ্জে ৫০টি এবং নওয়াপাড়া নদী বন্দর থেকে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে৷ সারা দেশে ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ নদী দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে৷
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবর রহমান হাওলাদার জানান, ‘‘নদী যারা দখল করেন, তারা প্রধানত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি৷ সাধারণ মানুষ নদী দখল করে না৷ আর ওই প্রভাবশালীরাই নানা কৌশলে দখল বহাল রাখতে চায়৷ ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে আমি একাধিক দখলদার পেয়েছি যারা সংসদ সদস্য৷’’
আর এই দখল উচ্ছেদ করার প্রধান দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের৷ আইনে আরো ১৭ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছে ৷ তারা সেটা না করে দখলদারদের সহায়তা করে৷
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল ইয়ার্স অ্যাসেসিয়েশন (বেলা)-র প্রধান সৈয়দা রিজওয়না হাসান বলেন, ‘‘হাইকোর্ট নদী রক্ষা কমিশনকে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করার একটি পরিকল্পনা জমা দিতেও বলেছিলেন৷ কিন্তু সেটা তারা এখনো দেয়নি৷’’
তিনি জানান, ‘‘সর্বশেষ যে ৪৮টি নদীর দখদলারদের যে তালিকা করা হয়েছে সেটা নদীর প্রবাহ ধরে করা হয়েছে৷ কিন্তু এখন সেটা সিএস খতিয়ান দেখে করা হচ্ছে৷ আর এই কারণে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না৷’’
তার কথা, ‘‘হাইকোর্টের আদেশ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারছে না৷ আর ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে যোগশাজশ করেই নদী দখল করা হয়৷ ফলে দখলদারদের নামে রেকর্ড হয়েছে৷ তারা খাজনা দিয়েছে৷ আর বর্তমান নদী রক্ষা কমিশন দিকপালহীন৷ এইসব কারণে দখলদারদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না, দখল আরো বাড়ছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘দখল উচ্ছেদের সঙ্গে আইনে ফৌজদারী মামলা করারও বিধান আছে৷ কিন্তু এই মামলা হলে সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও আসামি হয়ে যাবেন দখলে সহযোগিতা করার অপরাধে, তাই মামলা হয় না৷’’
মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘নদী দখল ফৌজদারী অপরাধ৷ জেলা প্রশাসন এই মামলার উদ্যোগ নিতে পারে৷ আরো যারা দায়িত্বে আছেন তারাও মামলা করতে পারেন৷ উচ্ছেদের সঙ্গে ফৌজদারী মামলা করে নদী দখলদাররা ভয় পাবে৷’’
নদী জীবন্ত সত্তা
২০১৯ সালে হাইকোর্ট তুরাগ নদসহ দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে৷ আর নদীর দখলদারকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণার আদেশ দেয়৷ কিন্তু এইসব ঘোষণার বাস্তব কোনো প্রতিফলন নেই৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার পর এখন নদী জীবন্ত ব্যক্তির অধিকার ও আইনগত প্রটেকশন পাবে৷ কিন্তু সেজন্য তো আইন করতে হবে৷ জীবনহানি বা ক্ষতির যে অপরাধ সেই অপরাধে দায়ী করতে হলে আইন প্রয়োজন৷ কিন্তু সেই আইন করার কোনো উদ্যোগ নেই৷ আদালতের নির্দেশনা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই৷’’
‘‘আর নদী দখলদারদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য করার যে আদেশ তা আপিল বিভাগে গিয়ে পর্যবেক্ষণ হয়ে গেছে৷ তারপরও সরকার চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ আইন করতে পারে,’’ বলে মনে করেন তিনি৷ তার কথা, ‘‘নদী কমিশন যে তালিকা করেছে, সেটা রাষ্ট্রপতিকেও দেয়া হয়েছে৷ আদালতেও আছে৷ তাই এই তালিকা ধরেই কাজ করা যায়৷ কিন্তু ২০১৯-২০ সালের পর যেন সব কিছু ঝিমিয়ে পড়েছে৷ এখন আর আমরা উচ্ছেদের খবরও পাই না৷’’
মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিতে পারে ঋণ খেলাপিদের মতো৷ নদী রক্ষা কমিশনের সহায়তা নিতে পারে৷ তার তালিকা যদি ওয়েবসাইটে থাকে, তাহলে দখলদার কারা মানুষ তাদের নাম জানবে৷ এটা একটি সামাজিক চাপ সৃষ্টি করবে৷’’
নদী রক্ষা কমিশন ঝিমিয়ে গেছে
রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘‘নদী দখল এখন সারাদেশে৷ আগে ঢাকা এবং বড় শহরের আশপাশের নদী দখল হতো৷ এখন প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়ও নদী দখল হচ্ছে৷ আর দখলদাররা সবাই প্রভাবশালী৷ তারা ব্যবসায়ী অথবা রাজনৈতিক নেতা৷ প্রশাসনের সহায়তায় তারা দখল করেন৷ ফলে তাদের থামানো যায় না৷ আর নদী রক্ষা কমিশন সুপারিশ করতে পারে৷ তারা সরাসরি উচ্ছেদ করতে পারে না৷ আইনে তাদের সীমবদ্ধতা আছে৷ তাদের আরো শক্তিশালী করা দরকার৷ লোকবল দেয়া দরকার৷’’
নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন নোঙরের সভাপতি সুমন শামস অভিযোগ করেন, ‘‘এখনকার কশিমন অনেকটাই নদী দখলদারদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে৷ আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সংগঠনের চারজনকে বাদ দিয়েছি নদী দখলদারদের সহযোগী হওয়ার কারণে৷ কিন্তু তাদের নদী কমিশন আবার জেলা কমিটিতে জায়গা দিয়েছে৷’’
তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘‘এখন নদী রক্ষা কমিশন যারা নদী নিয়ে কাজ করেন তাদের সহ্য করতে পারে না৷ মনে হয় তারা নদী রক্ষা নয়, অন্য কোনো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে৷’’
মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘নদী রক্ষা কমিশনকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে সেটা ঠিকমতো প্রয়োগ করলেও অনেক কাজ হয়৷ আমাদের সময় হাইকোর্ট আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে৷ আইনজীবীরা করেছেন, পরিবেশ ও নদী রক্ষায় যারা কাজ করেন, তারা সহযোগিতা করেছেন৷ আসল কথা হলো, যদি কমিশনের মধ্যে সমস্যা থাকে, তাহলে তো কাজ ঠিকমতো হবে না৷’’