1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নতুন সরকারের যত চ্যালেঞ্জ

সাংবাদিক
মাসুদ কামাল
২৩ আগস্ট ২০২৪

আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে ভারতে চলে গেলেন, দেশের ওপর চেপে থাকা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে গেল৷

https://p.dw.com/p/4jqYb
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সাথে করমর্দনের সময় ড. ইউনূস
ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিলেন, তখন তার সামনে লক্ষ্য হিসাবে যে বিষয়টির কথা বলা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে—সংস্কার৷ ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP

রাজধানীতে থাকা সরকারের মন্ত্রীরা, সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, সরকারের সুবিধাভোগীরা, হঠাৎ করেই যেন হাওয়া হয়ে গেলেন৷

আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে ভারতে চলে গেলেন, দেশের ওপর চেপে থাকা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে গেল৷ রাজধানীতে থাকা সরকারের মন্ত্রীরা, সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, সরকারের সুবিধাভোগীরা, হঠাৎ করেই যেন হাওয়া হয়ে গেলেন৷

কেবল ঢাকাতেই নয়, একই সঙ্গে বিভিন্ন জেলা, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও নেতা-কর্মী-সুবিধাভোগীদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে উপলব্ধি করলো, শেখ হাসিনা তার অপশাসনের মাধ্যমে কেবল দেশকেই নয়, একই সাথে তার পিতার ইমেজ এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও দৃশ্যত কবর দিয়ে গেছেন৷ ফলে এর তিনদিন পর  ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটা অন্তবর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করলো, তখন তাদের সামনে দেশজুড়ে কার্যত কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না৷ এতদিন যারা আওয়ামী লীগ কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে, সেই বিএনপি কিংবা জামায়াতের মধ্যেও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোনো তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা গেল না৷ বরং তারা ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানালো৷

ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিলেন, তখন তার সামনে লক্ষ্য হিসাবে যে বিষয়টির কথা বলা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে—সংস্কার৷ কোটা সংস্কার দিয়ে শুরু হয়ে আন্দোলনটি যখন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিলো, তখনও কিন্তু মূল দাবিটি ছিল ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ ও বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠনের৷ অর্থাৎ, এমন একটা সমাজ ও সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যাতে আর কোনো ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে, যাতে আর কোনো শাসক নিজেকে স্বৈরাচারীতে পরিণত করতে না পারে৷ আর এ জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে হবে৷ যে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে, তাদের এমন প্রত্যাশার কথা জেনেই দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার৷

দায়িত্ব নেওয়ার দিন কয়েক পর বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন ড. ইউনূস৷ সেখানেও তিনি সেই একই কথা বলেন৷ তিনি জানান, তার সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে—আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন৷ অর্থাৎ, একটা সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর জন্য আগে তারা শাসনপদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করবেন, তারপর একটা নির্বাচন দেবেন৷ সেই নির্বাচনে জনগণ যাদেরকে বেছে নেবে, তারাই দেশ চালাবে৷

এখানে একটা বিষয় কিন্তু জরুরি৷ সেটা হচ্ছে, সংস্কার যতদিন সম্পন্ন না হবে ততদিন দেশ তো চালাতে হবে৷ সেই দেশ চালানোর দায়িত্ব কিন্তু এই সরকারই নিয়েছে৷ তাদেরকেই চালাতে হবে দেশ৷ দীর্ঘ ও টানা দেড় দশক হাসিনা সরকারের হাতে পড়ে দেশ এক বিকট বাস্তবতার মুখোমুখি এখন৷ বিপুল ব্যয় ও লুটপাটের মাধ্যমে বেশ কিছু বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠেছে৷ অবকাঠামোগুলোর সুফল জনগণ ভোগ করছে৷ পাশাপাশি বাড়তি ব্যয়ের জন্য বাড়তি ঋণ যেটা করতে হয়েছে, সেটা পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ লাগামহীন অর্থ পাচারের কারণে ব্যাংকগুলো ফোকলা হয়ে গেছে৷ চাপ পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রায়, রিজার্ভে৷ পাঁচ ছয়টা গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে দেশের পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম৷ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ বাজার জিম্মি হয়ে পড়েছে কয়েকটি সিন্ডিকেটের কাছে৷ পণ্য পরিবহণে চাঁদাবাজি যেন একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে৷ সরকারি দলের পাণ্ডাদের পাশাপাশি পুলিশও প্রকাশ্যে নেমে পড়েছে এই চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতায়৷ অর্থনীতির এমন বাস্তবতা কিন্তু এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে একেবারে প্রথম দিন থেকেই৷ কতটুকু তারা পারছে, কিংবা কতটুকু পারবে সামনের দিনগুলোতে—সেসবও বড় প্রশ্ন৷

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন বাজারে একটু ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল৷ তারপর আবার সেই আগের অবস্থা৷ ব্যাখ্যাটি ঠিক বোধগম্য নয়৷ দাম কমে যাওয়ায় মানুষ শুরুতে ভেবেছিল—চাঁদাবাজি না থাকায় বুঝি হয়েছে এমন৷ কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই যখন দাম গিয়ে ঠেকল আগের অবস্থায়, তখন আর নিজে নিজে কোন ব্যাখ্যাই করা যাচ্ছে না৷ সরকারও কোন কথা বলছে না এসব নিয়ে৷ ব্যস্ত তারা দেশজুড়ে আওয়ামী ‘জনপ্রতিনিধি'দের চাকরি খাওয়া নিয়ে৷ প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে যারা সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র হয়েছিলেন, তারা সবাই সরকারের এক নির্দেশে বেকার হয়ে গেলেন৷ আর সংসদ সদস্যদের পদ তো গেছে আরও আগেই, সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই৷

রাজনৈতিক এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো আপত্তি দেখা যাচ্ছে না৷ বরং সবাই কিছুটা আনন্দিতই হচ্ছে৷ ভেবেছে—যাক, স্বৈরাচারের প্রতিনিধিগুলো বিদায় হয়েছে৷ কিন্তু আসলেই হয়েছে কি? নতুন কিছু ব্যক্তিকে অন্য রাজনীতির মোড়কে সেই চেয়ারগুলোর আশপাশে কি দেখা যাচ্ছে না? এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের লেবাসধারীদের আনাগোনার কথা৷ যারা এরকম অভিযোগ করছেন, তাদের কণ্ঠে যেন দেখা যাচ্ছে হতাশার সুর৷ ধারণা করা যায়, এভাবে চলতে দিলে এর মাত্রা আগামীতে আরো বাড়তে থাকবে৷ মানুষের এরকম হতাশা দূর করার দায়িত্ব কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সরকারকেই নিতে হবে৷ সেটা না পারলে হয়ত সরকারকে নিয়েই মানুষ হতাশ হয়ে পড়বে৷

সামনের সময়গুলোতে সরকারের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, এমনকি খোদ আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যন্ত বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ এ কথা মানতেই হবে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন টিকিয়ে রাখতে তাদেরকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে কিন্তু এই পুলিশ বা র‌্যাবই৷ এই বাহিনীগুলোতে গত ১৫ বছরে যারাই ঢুকেছে, তাদেরকে একটা কঠিন ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে৷ পরিবারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে এমনভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে, যেন এই দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য পরিবারের এইসব বাহিনীতে প্রবেশের কোনো অধিকারই নেই৷ সেই সব চিহ্নিত দলীয় সন্তানরা কিন্তু এই ১৫ বছরে অনেকদূর পর্যন্ত শিকড় বিস্তার করে ফেলেছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সরকারকে সেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ করা ব্যক্তিদের ওপরই নির্ভর করতে হবে৷ একই কথা বলা যায় আমলাতন্ত্র নিয়েও৷ এই যে এত বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেল ছাত্র জনতার, এদের পক্ষে কিছুমাত্র সহযোগিতা কি করেছে কোনো আমলা? করেনি৷ অথচ তারাই এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে সকল প্রশাসন৷ একথা কিন্তু মানতেই হবে, স্বৈরতন্ত্রের আমলা ও প্রশাসন দিয়ে কখনো একটা বিপ্লবী সরকার চলতে পারে না৷ পুলিশ আর আমলা বিষয়ক এই যে বাস্তবতা, আমর ধারণা এগুলো ভোগাবে এই সরকারকে৷  

অনেকে বলেন, নামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলেও এই সরকারের চেহারাটা কিন্তু অনেকটা বিপ্লবী সরকারের মতোই৷ অনেকটা এ ধরনের যে সরকারটিকে আমরা চিনতাম, সেটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ সেটি আসতো সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে৷ আর এই সরকার এসেছে একটা গণ-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে৷ আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারাই বসিয়েছে এদেরকে ক্ষমতায়৷ কেবল তাই নয়, আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া দুজন ছাত্রও রয়েছেন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে৷ এ হিসাবে বলা যায়, এই সরকার আসলে আন্দোলনেরই ফসল, আন্দোলনকারীদেরই সরকার৷ কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? আমার সেরকম মনে হয় না৷ আমার বরং মনে হয়, এই যে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা, এদেরকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা না গেলে এরাই বরং এই সরকারের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে৷ হাসিনার মতো স্বৈরাচারকে ফেলে দেওয়ার পর এদের আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়ে গেছে যে, এইচএসসি পরীক্ষা হবে নাকি বাতিল করা হবে—এমন ইস্যুতেও তারা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ে চলে যাচ্ছে৷ নিজেদের দাবি আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে৷ আগামী দিনগুলোতে এরকম মিছিল যে আরো ঘনঘন হবে না, তার কোনোই গ্যারান্টি দেওয়া যায় না৷ আমার তো মনে হয় আন্দোলনকারী এই ছাত্র জনতা সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবেও আবির্ভূত হতে পারে৷  

লেখাটি শেষ করতে চাই বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে ড. ইউনূসের বলা না বলা কথাগুলো দিয়ে৷ তিনি সেখানে নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলেছিলেন৷ তাঁর ভাষায়—আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন৷ তর্কপ্রিয় পাঠক ‘সংস্কার’-এর সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন৷ কোন ক্ষেত্রে কতটুকু পরিবর্তনকে ঠিক ‘সংস্কার'বলা যাবে, অথবা এই সরকার ‘সংস্কার'হয়েছে বলে মনে করবেন—সেটা কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত নয়৷ পাশাপাশি আরেকটা জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে—প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিক কতদিন সময় নেবে? কূটনীতিকদের সে বৈঠকে ড. ইউনূস কিন্তু সময়ের বিষয়ে কিছু্ই বলেননি, কোনো ইঙ্গিতও দেননি৷

এই যে, কী করতে চান—তা বলা, আর এই কাজগুলো করতে কতদিন সময় নিতে চান—তা না বলা, এটাই আসলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং জনগণের মধ্যে একটা বড় প্রশ্ন হিসাবে লটকে থাকবে৷ শুরুতে মানুষ সময় দেবে, সময় নিয়ে প্রশ্ন করবে না৷ এটাই স্বাভাবিক৷ এমনই হয়৷ ওই যে বলা হয়ে থাকে হানিমুন পিরিয়ড, অনেকটা সেরকম৷ তবে আমার কেন যেন মনে হয়,  সেই সময়টা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে৷ মানুষ প্রশ্ন করতে থাকবে, যতই দিন যাবে প্রশ্নের ধার বাড়তে থাকবে৷ আমার ধারণা, এই বিষয়টিও অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ কেবল নয়, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দ্রুতই আবির্ভূত হবে৷

পুলিশে কী কী সংস্কার হবে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য