নগরে আজ বাউল নেই, দলছুটরা হারিয়ে গেছে
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮২০০০ সাল৷ ডিসেম্বর মাস৷ শামসুন্নাহার হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ভর্তি হয়েছি৷ একদিন হঠাৎ হলে বেশ হইচই৷ ব্যাপারটা কি৷ ডিসেম্বর মাসে হলের বার্ষিক ভোজ এবং পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়৷ এবারের অনুষ্ঠানে ব্যান্ড নগর বাউল৷ অর্থাৎ জেমস আসবে৷ ব্যান্ড সংগীতের প্রতি আমার তখনো কোনো অনুরাগ জন্মেনি৷ মফস্বল শহরে থাকতে রাস্তা-ঘাটে এলআরবি, আর্ক, নগর বাউলের কয়েকটা জনপ্রিয় গান কানে এসেছে, টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠানে কখনো কখনো শুনেছি৷ কিন্তু পছন্দ বা ভালো লাগা তৈরি হয়নি৷
তাই মেয়েদের এত উচ্ছ্বাস দেখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি জেগেছিল৷ তারপর এই সেই ক্ষণ৷ মেয়েদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের পর তিনি এলেন৷ কালো একটা লম্বা পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট, কাঁধে গামছা৷ কেমন যেন একটু এলোমেলো ভাব৷ কী কথা বলেছিলেন মনে নেই৷ তবে প্রথম গানেই আমি মোটামুটি ধরাশায়ী৷ যখন উদাত্ত গলায় শুরু করলেন ‘ইয়া রব ইয়া রব'৷ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো যেন৷ এরপর চললো একের পর এক অসাধারণ কিছু গান–আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, দুঃখিনী দুঃখ করো না, বাবা কতদিন দেখিনি তোমায়, পদ্ম পাতার জল, মা..৷ সেদিন থেকে আমি তাঁর দারুণ ভক্ত৷ আসলে লাইভ ব্যান্ডের যে আবেদন, সেটা তো আর ক্যাসেটে উপলব্ধি করা যায়নি, তাই হয়তো ভালো লাগাও তৈরি হয়নি৷
আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমার আসলে ব্যান্ডের প্রতি ভালোবাসা৷ আমার আত্মীয় পল্লবী, মিথুন, বিন্নীকে এর অনেকটাই ক্রেডিট দেয়া যায়৷ মিথুন ছিল আর্কের ভোকাল হাসানের ভক্ত৷ হাসান কোনো ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে এলে সেই ম্যাগাজিন তার কেনা চাই, গানের ক্যাসেট বের হলে তো কথাই নেই৷ সেই হাসান যখন বিয়ে করলন, তখন মিথুনের দুঃখ কে দেখে৷ মিথুনের বদৌলতে হাসানের প্রায় প্রতিটা গান আমার শোনা৷ ওদের কাছেই মাইলস, এলআরবি, রেনেসাঁ, দলছুট, সোলস, নগর বাউলের গান শোনা এবং তখন আমার তাঁদের গাওয়া বিখ্যাত সব গান প্রায় কণ্ঠস্থ৷ এরও পরে শুনেছি আজম খানের বাংলাদেশ, ফেরদৌস ওয়াহিদের জনপ্রিয় গান ‘এমন একটা মা দেনা'৷
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে এই প্রতিটা ব্যান্ডের লাইভ কনসার্ট দেখার সুযোগ হয়েছিল৷ আমরা ক্যাম্পাসে থাকাকালীন ‘বাংলা ব্যান্ড' তাদের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করে৷ আর সেই গানগুলো তখন সবার মুখে মুখে৷ মেয়েদের হল বন্ধ হয়ে যেতো রাত সাড়ে ৯ টায়৷ বিশেষ অনুমতি নিয়ে চারুকলার বকুল তলায় বাংলা ব্যান্ডের গান শুনেছি কতদিন!
ব্যান্ড সংগীতে বাংলাদেশে আসলে একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল ৯০-এর দশকে৷ কারণটা ছিল সংগীতায়োজন, কথা এবং সুর৷ অসাধারণ কিছু গীতিকার ছিলেন, যাঁরা ব্যান্ডসংগীতকে প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন৷ যাঁদের বুকে বিচ্ছেদের বেদনা বাজছে, তাঁদের চোখকে আরও সজল করে দিতো ‘সানাইয়ের সুর নিয়ে যাবে দূর একটু একটু করে তোমায়...', অথবা ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে...' ৷ অথবা মিষ্টি ভালোবাসার গান ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে...', রেনেসাঁর সমাজ সচেতনতার গান ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে...' আর জন্মদিন এলে মাইলসের ‘আজ জন্মদিন তোমার' কে না গায়! কী অপূর্ব এবং অসাধারণ গানের কথা৷
মাইলস, এলআরবি, সোলসের পর অবস্কিউর, ফিডব্যাক, শিরোনামহীন, আর্টসেল, ওয়ারফেজও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্যান্ড সংগীতে কেমন একটা অচলাবস্থা তৈরি হলো৷ বেশিরভাগ ভালো ব্যান্ডগুলোর মধ্যে দেখা দিলো ভাঙন৷
বর্তমানে যে কয়টি ব্যান্ড কিছুটা হলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম চিরকুট ও জলের গান৷ আর অর্নব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস হঠাৎ হঠাৎ দু-কটা ভালো গান নিয়ে হাজির হয়৷
বর্তমানে কোনো ব্যান্ডের নামই তেমন একটা শোনা যায় না৷ কখনো কখনো হয়ত কোনো একটা গান হিট হয়, তারপর সবাই ভুলেও যায় গায়ক এবং ব্যান্ডের নাম৷ প্রযুক্তির কল্যাণ আর বস্তাপচা কথার বদৌলতে সস্তা দরের গান আর স্পন্সরদের খুশি করাই এখন ব্যান্ডগুলোর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন৷
আগে ব্যান্ডসংগীত কেবল ভালোবাসা, প্রেম, ভালোলাগার কথাই বলতো না, সমাজ সচেতনতার কথাও বলতো৷ তারা কেন হারিয়ে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর কি আমরা খুঁজেছি কখনো? ব্যান্ডসংগীত কি আবার তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে না? ‘চল বু বাইজান মাটি কাটা চাইয়া রইলি কার পানে....' এমন গান কি আর তৈরি করা সম্ভব না?
তবে পাওয়ারসার্জ, আরবোভাইরাস, এভোয়েড রাফা, ওল্ড স্কুল, ছাতক, মিনেরেবা-র মতো নতুন ব্যান্ডগুলো নতুন আঙ্গিকে ব্যান্ডসংগীতের ধারা ক্রমবর্ধমান রাখুক, পুরোনো ঐতিহ্যকে আরও সম্মুন্নত করুক এই প্রত্যাশা৷
লেখকের সঙ্গে আপনি কি একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷