‘দ্রব্যমূল্য নাগালের বাইরে চলে গেছে- এটা সাংবাদিকদের ভাষা’
২৮ অক্টোবর ২০২২ডয়চে ভেলে : প্রধানমন্ত্রী বারবার খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন৷ একই সঙ্গে এ-ও বলছেন, এক টুকরো জমিও ফেলে রাখা যাবে না৷ প্রধানমন্ত্রী ঝুঁকির যে ইঙ্গিত করেছেন, এটা কেন?
ড. শামসুল আলম : ইঙ্গিতটা এই জন্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা জাতিসংঘের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তারাই এই খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছেন৷ সেই বিষয়টাই প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে প্রতিধ্বনিত করেছেন৷ আন্তর্জাতিকভাবে যেটা বলা হচ্ছে, দেশবাসীকে তিনি সেটা অবহিত করছেন এই জন্য যে, আমরা যেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারি৷ এবং যারা সংশ্লিষ্ট, তারা যেন প্রস্তুতি নিতে পারেন৷ তার প্রেক্ষাপটেই তিনি বলছেন, কোথাও যেন এক টুকরো জমি পতিত না থাকে৷ যার যতটুকু আছে তাতে যেন আমরা খাদ্য উৎপাদন করি৷ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, জাতীয় নেত্রী হিসেবে, আন্তর্জাতিক নেত্রী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক কথাগুলোই দেশে প্রতিফলিত করছেন৷ আমি মনে করি, প্রস্তুতির জন্য এবং দেশবাসীকে অবহিত করার জন্য এটা প্রয়োজন৷ এটা অত্যন্ত জরুরি৷ এটা বিশ্ব সমস্যা, বাংলাদেশের সমস্যা না, বাংলাদেশের সৃষ্ট সমস্যাও না৷
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কেমন?
বিশেষ করে চালের ক্ষেত্রে তো আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রায়৷ সেক্ষেত্রে আমাদের মজুদও যথেষ্ট ভালো৷ আমন যদি আমরা যথাযথভাবে কাটতে পারি, তাহলে বিশ্বে যেভাবে সতর্কতা দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমরা সংকটে নিপতিত হবো না৷ বিশেষ করে খাদ্যের বিষয়ে৷ যদি কোনো দৈব দুর্বিপাক বা ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতি না হয় আমনটা ভালোভাবে কাটতে পারবো বলেই আশা করি৷ সারাদেশে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সমন্বিত কার্যক্রম চলছে, যাতে কৃষিতে কোথাও কোনো ঘাটতি না হয়৷ সার, বীজ, যন্ত্রপাতি যেন কৃষকরা যথাসময়ে পেতে পারেন, সেইক্ষেত্রে ভর্তুকি অব্যহত রাখা হয়েছে৷ সারে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে এবং যথাসময়ে সার আমদানি করা হচ্ছে৷ কাজেই আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে যথাযথ৷
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলছেন, প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে৷ এসব কথা কীসের আলামত?
এটা তো উপদেষ্টা মহোদয়ের বক্তব্য৷ এ নিয়ে আমি কী বলবো? কী প্রেক্ষাপটে উনি বলেছেন সেটা উনিই ভালো জানেন৷ এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই৷ আমি বক্তব্যটা দেখেছি, এ পর্যন্তই৷
এতদিন বলা হয়েছে দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো, চিন্তার কিছু নেই৷ কিন্তু এখন সবদিক থেকে অন্যরকম সুর শোনা যাচ্ছে৷ এসবের কারণে কি প্যানিক তৈরি হবে না?
আর্থিক অবস্থা ভালো বলা হচ্ছিল, এই কারণে যে, আমরা আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা দেখিয়েছি৷ কোভিডকালে আমাদের ব্যবস্থাপনা ছিল চমৎকার৷ ভ্যাকসিন যখন আবিস্কার হয়নি, তার আগেই আমরা ক্রয় করে ফেলেছি৷ এই নিশ্চয়তা ছিল যে, সত্যিই আবিস্কার হবে৷ তা না হলে আমাদের টাকা তো মারই যেতো৷ তবুও প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সেই উদ্যোগ নিয়েছি৷ আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যাপকভাবে দিয়েছি সকল উৎপাদক শ্রেণিকে৷ সকল ব্যবসা-বাণিজ্যে সেই প্রণোদনা ছিল৷ আমাদের অর্থনীতি মোটামুটি ভালোই চলছিল৷ এখনো আমরা ভালোভাবে এগোচ্ছি৷ জ্বালানি সমস্যা তো আমাদের সৃষ্ট সমস্যা নয়৷ দরদাম যে বেড়ে গেল ১০০-২০০ পার্সেন্ট সেটা তো আমাদের সৃষ্ট না৷ আমরা যথাযথভাবেই অর্থনীতি এগিয়ে নিচ্ছি৷ বড় দেশগুলো যে ধরনের সংকটে পড়েছে, সেই তুলনায় আমরা যথেষ্ট সক্ষমতা দেখিয়েছি৷ চাপ আছে, কিন্তু সেই চাপকে মোকাবেলা করার যে সক্ষমতা সেটাও আমরা দেখিয়েছি৷ এটা আমাদের ‘আশ্বস্তের’ দিক৷
রিজার্ভ নিয়ে এতদিন নানা কথা বলা হলেও এখন তো দেখা যাচ্ছে ৩৫ বিলিয়নের নীচে নেমে গেছে৷ এটা কী ঝুঁকির ইঙ্গিত করে?
রিজার্ভে ওঠানামা হতেই পারে, হচ্ছে৷ কারণ, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়েছে আমদানি করতে৷ যেহেতু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে৷ একই পরিমাণ আমদানি করে আমাকে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে৷ পরিবহণ ব্যয় আড়াই থেকে তিনগুণ বেড়েছে৷ কাজেই কিছু রিজার্ভ কমেছে৷ রিজার্ভ ছিল বলেই তো আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি৷ এই কারণে সংকটে পড়িনি৷ রিজার্ভ থাকেই সংকটে যেন ব্যবহার করতে পারি সেজন্য৷ এখনো যে রিজার্ভ আছে তাতে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব৷
দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা খাদ্য ঝুঁকির কথা বারবার বললে, মানুষ কি জিনিসপত্র কিনে মজুদ করার চেষ্টা করবে না? এতে করে কী জিনিসপত্রের দাম আরো বেড়ে যাবে না?
মজুদ করবে না, তারা প্রস্তুতি নেবে৷ বেআইনি মজুদ করার সুযোগ নেই৷ যারা বেআইনি মজুদ করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং হবে৷ যারা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি মজুদ করেছেন তাদের জরিমানা করা হয়েছে৷ বিশ্বে কী ঘটছে সেটা জাতিকে অবহিত করে রাখতে হবে৷ উন্মুক্তভাবে দেশবাসীকে সবকিছু জানানো হচ্ছে৷ লুকোচুরির সরকার এটা নয়, লুকোচুরির প্রবণতা এই সরকারের নেই৷
বর্তমানে দ্রব্যমূল্য তো মানুষের নাগালের বাইরে৷ জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে৷ জনগণকে স্বস্তি দিতে সরকারি উদ্যোগ কি যথেষ্ট?
এটা সাংবাদিকদের ভাষা৷ যাদের একেবারে (বেশি) কষ্ট, তাদের জন্য সরকার এককোটিরও বেশি পরিবারকে সস্তায় প্রয়োজনীয় পণ্যাদি দেওয়া হচ্ছে৷ আপনি ঢাকার সুপার মার্কেটগুলোতে ঘুরে আসলে দেখবেন, আপনাকে কাউন্টারে যেতে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ তার মানে মানুষ ক্রয় করতে পারছে না তা নয়৷ একটা শ্রেণি, যারা ক্রয় করতে পারছে না তাদের জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে৷ বাদবাকি মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তের সকল অংশই কিন্তু চালিয়ে যেতে পারছে৷ কারণ, আমাদের আয় কয়েকগুণ বেড়েছিল৷
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কতটুকু?
মূল্যস্ফীতির পুরেটাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে৷ কারণ, আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থার পুরোটাই স্বাভাবিক ছিল৷ পরিবহণ ব্যয় এবং দাম বৃদ্ধির পুরোটাই এই যুদ্ধের কারণে৷
পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কী চিন্তা করছে?
সরকার অত্যন্ত তৎপর রয়েছে৷ উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্দীপনা দিচ্ছে৷ মানুষকে সতর্ক করছে যে, কৃষিতে যেন অবহেলা না করি৷ শিল্প-কলকারখা যেন চালু থাকে, সেজন্য জ্বালানি আমদানি করা হচ্ছে৷ সরকার সর্বক্ষেত্রেই সক্রিয় রয়েছে৷ আমরা চাচ্ছি যেন উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে৷ যেখানে প্রয়োজন সেখানে ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে৷ এই কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অনেক বেড়েছে৷ সরকার তো বলেছে, প্রয়োজনে আরো বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে৷ ব্রুনাইয়ের সুলতান যে এসে গেলেন, তার দেশ থেকেও এলএমজি আমদানি করা হবে৷ সরকার অত্যন্ত তৎপর রয়েছে৷