1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দাপুটে জয়ে ১০ বছর পর ফাইনালে ভারত

রাহেনুর ইসলাম
২৭ জুন ২০২৪

গায়ানায় দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৬৮ রানে হারালো ভারত। রোহিত শর্মার দলের ৭ উইকেটে ১৭১ রানের জবাবে ইংল্যান্ড অলআউট ১০৩ রানে। দাপুটে জয়ে ২০১৪ সালের পর আবার ফাইনালে ভারত।

https://p.dw.com/p/4hbul
মঈন আলীকে আউট করার পর ম্যান অব দ্য ম্যাচ অক্ষর প্যাটেলের উল্লাস
ম্যান অব দ্য ম্যাচ অক্ষর প্যাটেলছবি: Randy Brooks/AFP/Getty Images

মিলটা অবিশ্বাস্য। এবারের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের আগে রোহিত শর্মা ও জস বাটলার খেলেছিলেন সমান ১২০টি বল, রান ১৯১ এমনকি স্ট্রাইক রেটও ঠিক ১৫৯.১৬! হিসাবটা ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে করলেও মিল অনেক। ভারত ও ইংল্যান্ডের দুই অধিনায়ক খেলেছিলেন সমান ৯ ম্যাচ, বল ১৯২টি, অপরাজিত ২ ম্যাচ আর ফিফটি ঠিক ২টি!

এই মিল শুধুই কাকতালীয়, নাকি ক্রিকেট ঈশ্বরের খেয়াল?

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগে বুঝিয়ে দেওয়া-সেনাপতি এমন সমানে সমান না হলে যুদ্ধের আদর্শ ক্ষেত্র তৈরি হবে কীভাবে?

আইসিসির প্লেয়িং কন্ডিশনটা অবশ্য এমন সমান ছিল না। সূচি তৈরির সময়ই ভারত জানতো সুপার এইট চ্যাম্পিয়ন বা রানার্সআপ যা-ই হোক-সেমিফাইনালের টিকিট পেলে তারা খেলবে গায়ানার প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে। আজ সকালে প্রথম সেমিফাইনালে প্রোটিয়াদের কাছে আফগানিস্তানের হারের পর এর সমালোচনা করে ইংলিশ সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন ‘এক্স'-এ, ‘‘পুরো ইভেন্টেই যখন ভারতকে কেন্দ্র করে সাজানো, তখন অন্যদের সঙ্গে খুব অন্যায় হয়ে গেছে।''

আদিল রশিদের বলে বোল্ড হয়ে গেলেন রোহিত শর্মা
ব্যাট হাতে আবার সফল অধিনায়ক রোহিত শর্মাছবি: Gareth Copley/Getty Images

মাইকেল ভনের মতো লিখে বা মুখে বলে এর পাল্টা জবাব দেওয়ার উপায় নেই ভারতীয় ক্রিকেটারদের। তাদের হাতিয়ার ব্যাট-বল। আজ দ্বিতীয় সেমিফাইনালে রোহিত শর্মার দল সেই ব্যাট-বলেই বোঝালো যোগ্য দল হিসেবেই ফাইনালে তারা। ভনের সাবেক দল আর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত থাকা ভারত।

২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতকে বিধ্বস্ত করেছিল ইংল্যান্ড। ম্যাচটা জিতেছিল ১০ উইকেটে। এবার সেই হারের প্রতিশোধ নিয়ে ১০ বছর পর এই ফর্ম্যাটের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত। শনিবার বার্বাডোজে তাদের প্রতিপক্ষ প্রথমবার বিশ্বকাপের শিরোপা মঞ্চে জায়গা পাওয়া সাউথ আফ্রিকা। দুই অপরাজিত দল হিসেবে এবারই প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে ভারত ও প্রোটিয়ারা।

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বর্ষাকাল শুরু হয় জুনের মাঝামাঝি সময়ে। এ কারণেই বেশিরভাগ ম্যাচে বাগড়া দিচ্ছে বৃষ্টি। অথচ প্রথম সেমিফাইনাল আর ফাইনালে রিজার্ভ ডে রাখা হলেও দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নেই। কারণ, সেমিফাইনালের একদিন পরই ফাইনাল। ঠাসা সূচির জন্য বৃষ্টি হলে বাড়তি ২৫০ মিনিট রাখা হয় সেমিফাইনালের জন্য। এই সময়ে কোনো ওভার কাটা ছাড়াই হবে খেলা। এরপরও বৃষ্টিতে খেলা না হলে সুপার এইটে বেশি পয়েন্টের সুবাদে ফাইনালে (ভারতের পয়েন্ট ছিল ৬, ইংল্যান্ডের ৪) যেতো ভারত।

আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি ছিল গায়ানায়। শঙ্কা ছিল ম্যাচ ভেসে যাওয়ারও। তাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে আইসিসির এক মুখপাত্র এর ব্যাখা দিয়ে জানান, ‘‘ রিজার্ভ ডে'তে পুরো ৪০ ওভারের ম্যাচের জন্য বরাদ্দ কিন্তু ঠিক ২৫০ মিনিট। দলগুলোর খেলা-ভ্রমণ-খেলার ব্যস্ততা এড়াতে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে সেই ২৫০ মিনিট বাড়তি রাখা হয়েছে।''

৪৭ রানের ইনিংস খেলার পথে সূর্যকুমারের একটি দৃষ্টিনন্দন শট
বিপদ সামাল দিতে আবার রোহিত শর্মার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়েন সূর্যকুমারছবি: Gareth Copley/Getty Images

আজ টস হতে দেরি হয় বৃষ্টির জন্য। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টসটা জিতে বোলিং নেন জস বাটলার। ব্যর্থতার বৃত্তে থাকা বিরাট কোহলি আজও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। সেমিফাইনালের আগে তার ইনিংসগুলো ১, ৪, ০, ২৪, ৩৭ ও ০। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এর আগের তিনটি সেমিফাইনালে খেলেছিলেন ৭২* (৪৪ বলে ২০১৪), ৮৯*( ৪৭ বলে ২০১৬) ও ৫০ (৪০ বলে ২০২২) রানের বিস্ফোরক ইনিংস।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এবার ব্যর্থ তিনি। আইপিএলে বেঙ্গালুরু সতীর্থ রিসে টপলির বলে বোল্ড মাত্র ৯ রানে। এবারের বিশ্বকাপে বাঁহাতি পেসারের বিপক্ষে ২১ বলে কেবল ২১ রানই করতে পেরেছেন কোহলি, আউট তিনবার।

আইপিএলে বিশ্বের সেরা তরকারা একে অন্যের সঙ্গে খেলায় জাতীয় দলের হয়ে আগের মতো রণহুঙ্কার দেখা যায় না আর। এজন্যই বৃষ্টিতে টস হতে দেরি হওয়ার সময় ভারতের সেরা পেসার যশপ্রীত বুমরা খুঁনসুঁটিতে মেতেছিলেন তার মুম্বাইয়ের সতীর্থ ও ইংল্যান্ডের ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের অনতম নায়ক জোফরা আর্চারের সঙ্গে।

২২ গজে অবশ্য ছাড় নয় কোনো। মুম্বাইয়ের আরেক সতীর্থ রোহিত শর্মা প্রথম ওভারেই বাউন্ডারি মেরে স্বাগত জানান আর্চারকে। নিচু বাউন্সের গায়ানার পিচটা ছিল ভারতের মতো। আর বৃষ্টিতে স্যাঁতস্যাঁতে কন্ডিশনটা ইংল্যান্ডের মতো। লড়াইটা তাই শুরু থেকেই জমজমাট। এ ধরনের পিচে খেলে বড় হওয়ায় আর্চার, টপলিদের নিচু হয়ে যাওয়া বলে সময়মতো ব্যাট নামাতে পারছিলেন রোহিত শর্মা আর সূর্যকুমার যাদব।

ঋষভ পান্ত অবশ্য স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। স্যাম কারানের বলে মিড উইকেটে জনি বেয়ারস্টোকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন কেবল ৪ রান করে। ভারত পাওয়ার প্লে-তে করে ২ উইকেটে ৪৬। তৃতীয় উইকেটে সূর্যকুমার যাদবের সঙ্গে রোহিত শর্মা জুটি গড়ে ভালো ভিত এনে দেওয়ার চেষ্টার সময়ই অষ্টম ওভার শেষে নামে বৃষ্টি।

উইকেট পাওযার পর আদিল রশিদের সঙ্গে ক্রিস জর্ডান
ম্যাচে ইংল্যান্ডের সফলতম বোলার ক্রিস জর্ডান (বাঁ দিকে)ছবি: Randy Brooks/AFP/Getty Images

রোহিত শর্মা ২৬ বলে ৩৭ আর সূর্যকুমার যাদব তখন ব্যাট করছিলেন ৭ বলে ১৩ রানে। ভারতের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৬৫। ২৩ করার সময়ই পঞ্চম ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে তিন ফর্ম্যাট মিলিয়ে ৫ হাজার রানের মাইলফলকে পা দেন রোহিত শর্মা। ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮৮৩ রানের রেকর্ডটা বিরাট কোহলির।

বৃষ্টিতে দুই দলের খেলোয়াড়রা মাঠ ছেড়ে যান অষ্টম ওভার শেষে। তাতে ইংল্যান্ডের উদ্বেগ বাড়লেও ভারতীয়রা নির্ভার। খেলা ভেসে গেলেও নিয়মের ভেলায় ভেসে তাদের ফাইনাল নিশ্চিত ছিল।

খেলা বন্ধ হওয়ার সময়ও নিয়ম অনুযায়ী ১৭৫ মিনিট ছিল। এই সময়ের মধ্যে খেলা শুরু হলে ওভার কাটা হবে না একটিও। বৃষ্টি থেমে সূর্যের দেখা মিললেও ভেজা মাঠের জন্য ঝুঁকি নেননি আম্পায়াররা। মাঠকর্মীরাও নিজেদের সর্বোচ্চটা চেষ্টা করে খেলার উপযোগী মাঠ প্রস্তুত করেন সময়মতোই।

রোহিত শর্মা ও সূর্যকুমার যাদবের তৃতীয় উইকেটে ৭৩ রানের জুটিটা ভাঙেন আদিল রশিদ। ৩৯ বলে ৬ বাউন্ডারি ২ ছক্কায় ৫৭ করেন তিনি। সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়ার পর সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও হাসলো রোহিতের ব্যাট। ‘বড় খেলোয়াড়রা' জ্বলে ওঠেন বড় মঞ্চেই!

৩৬ বলে ৪৭ করা সূর্যকুমারকে ফেরান আর্চার। শেষ দিকে হার্দিক পান্ডিয়ার ১৩ বলে ২৩ আর রবীন্দ্র জাদেজার ৯ বলে হার না মানা ১৭-তে ভারত থামে ৭ উইকেটে ১৭১ রানে। ক্রিস জর্ডান ৩টি আর ১টি করে উইকেট টপলি, আর্চার, কারান ও রশিদের।

গায়ানার এই উইকেটে গড় রান ১৬৫। তাই ১৭১ মোটেও পাহাড় টপকানোর চ্যালেঞ্জ ছিল না। ভারতীয় বোলাররা নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে এই পুঁজি নিয়ে শুরু থেকেই চেপে ধরেন ইংলিশ ব্যাটারদের।

সেমিফাইনালের আগে পর্যন্ত রোহিত শর্মার সঙ্গে মিল থাকলেও আসল মঞ্চে ব্যর্থ জস বাটলার। ১৫ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ২৩ করে অক্ষর প্যাটেলের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। অপর ওপেনার ফিল সল্টকে (৫ রান) বোল্ড করেন যশপ্রীত বুমরা।

এরপর মঈন আলীকে (৮) স্টাম্পড ও জনি বেয়ারস্টোকে (০) বোল্ড করে টপঅর্ডার গুঁড়িয়ে দেন অক্ষর প্যাটেল। অপর স্পিনার কুলদীপ যাদব ধসিয়ে দেন মিডলঅর্ডার। তিনি ফেরান হ্যারি ব্রুক (২৫), স্যাম কারান (২) ও ক্রিস জর্ডানকে।

আসলে ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন ভারতের স্পিনাররাই। ইংল্যান্ডের পেসাররা ১২ ওভারে ৬ উইকেট নিলেও রান দেন ১২০, ইকোনমি রেট ১০। তাদের স্পিনাররা ৬.১২৫ ইকোনমিতে ৮ ওভারে ৪৯ রানে উইকেট নেন কেবল ১টি।

উইকেট পাওয়ার পর কুলদীপ যাদবের উল্লাস
কুলদীপ যাদব : আবার ৩ উইকেটছবি: Randy Brooks/AFP/Getty Images

সেখানে ভারতের তিন স্পিনার ১১ ওভারে কেবল ৫৮ রান দিয়ে নেন ৬ উইকেট, ইকোনমি রেট ৫-এর সামান্য বেশি। অক্ষর প্যাটেল ২৩ রানে ৩ ও কুলদীপ যাদব ১৯ রানে নেন ৩ উইকেট। রবীন্দ্র জাদেজা উইকেট না পেলেও ৩ ওভারে দেন কেবল ১৬ রান। ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি বুমরা ২.৪ ওভারে ১২ রানে নেন ২ উইকেট।

সেমিফাইনালের একদিন আগে ছিল ভারতের ১৯৮৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের ৪১ বছর পূর্তি। লর্ডসের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে জেতা শিরোপাটা বদলে দিয়েছিল ভারতীয ক্রিকেট। সেই দলের রজার বিনি, সুনীল গাভাস্কার ও রবি শাস্ত্রীকে নিয়ে গায়ানায় কেক কেটে উপলক্ষ্যটা উদযাপন করেছেন বর্তমান দলের ঋষভ পান্ত ও মোহাম্মদ সিরাজ।

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে করা সেই অনুষ্ঠানে নিশ্চয়ই এবারের বিশ্বকাপটা উপহার হিসেবে চেয়েছিলেন তিন সাবেক তারকা। এজন্য আর একটা ধাপ পাড়ি দেওয়া বাকি। পারবেন তো রোহিতরা?

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ভারত : ২০ ওভারে ১৭১/৭ ( রোহিত ৫৭, সূর্যকুমার ৪৭, পান্ডিয়া ২৩, জাদেজা ১৭* ; জর্ডান ৩/৩৭, রশিদ ১/২৫)।

ইংল্যান্ড : ১৬.৪ ওভারে ১০৩/১০ (ব্রুক ২৫, বাটলার ২৩, লিভিংস্টোন ১১, মঈন ৮ ; অক্ষর ৩/২৩, কুলদীপ ৩/১৯)।

ফল : ভারত ৬৮ রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ : অক্ষর প্যাটেল ।

রাহেনুর ইসলাম সাংবাদিক