থামেনি ‘দীপনের জাগৃতি’
২৯ জানুয়ারি ২০১৯পেশায় চিকিৎসক রাজিয়া রহমান জলি বইমেলা এলে জাগৃতির স্টল সামলানোর দায়িত্ব নিতেন৷ পেশাগত দায়িত্বের বাইরে মেলার পুরোটা সময়েই তাঁকে দেখা যেতো জাগৃতির স্টলে হাসিমুখে বই বিকিকিনি করছেন৷ মেলা চলাকালে বই প্রকাশ ও তা স্টল পর্যন্ত পৌঁছানোর কাজটি করতেন ফয়সল আরেফিন দীপন, আর স্টলে পরিবেশনের দায়িত্ব নিতেন জলি৷ দু'জনে মিলেমিশেই মাসব্যাপী বইমেলা সামাল দিতেন তাঁরা৷ গত চার মেলা ধরে একাই লড়াই করে যাচ্ছেন রাজিয়া রহমান জলি৷
দীপন হত্যার ৩ মাস পর ২০১৬ সালে ২০টি নতুন বই নিয়ে মেলায় এসেছিলেন জলি৷ পরের তিন বছরে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'দীপনপুর', দীপনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি করা বুকশপ ক্যাফে৷ দীপনপুর থেকেই পরিচালিত হচ্ছে জাগৃতির কর্মকাণ্ড৷
এবার বই মেলায় জাগৃতির স্টলের ওপরে লেখা আছে ‘দীপনের জাগৃতি'৷ আর ট্যাগ লাইন ‘শুভবুদ্ধির উদয় হোক'৷ ২০১৫ সালে যেদিন একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়েছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, সেদিন হত্যাকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘‘আমি বিচার চাই না৷ আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক৷'' সেই বক্তব্যকেই ট্যাগ লাইন করেছে জাগৃতি৷
জাগৃতির গল্পটা এক অনন্য উদ্যোগের৷ ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করে বন্ধুরা যখন ব্যাংকে ঢুকলেন, কেউ দেশের বাইরে গেলেন উচ্চ শিক্ষা নিতে, তখন ফয়সল আরেফিন দীপন একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলে বসলেন৷ এরপর ২০১৫ পর্যন্ত লড়াই৷ ২০১৫ সালে অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পর বেশ কয়েকবার হুমকি পেয়েছেন৷ কিন্তু থামেনি প্রকাশক হিসেবে তাঁর লড়াই৷ এরপর জীবনটাও খোয়াতে হলো জঙ্গি হামলায়৷ সেই প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের জাগৃতির কর্মকাণ্ড একদিনের জন্য থামতে দেননি রাজিয়া রহমান জলি৷ জাগৃতি নিয়ে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন দেশে বিদেশে৷
২০১৭ সালে ৪০টি নতুন বই প্রকাশ করেছে জাগৃতি৷ ২০১৮ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৬৭-তে৷ এ বছরও সংখ্যাটি ৫৫ থেকে ৬০-এর মতো হবে৷এ মুহূর্তে প্রকাশনা ও স্টল গোছানো নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন রাজিয়া রহমান জলি৷
ডয়েচে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘জাগৃতি বা দীপনপুর-কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আসলে একটি প্রতিবাদ৷ দীপনের সন্তানদেরকে আস্থা দেওয়া যে, তাদের মা এক মুহূর্তের জন্যও প্রতিবাদ থামায়নি৷''
কখনো ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েন৷ ২০১৬ সালের বইমেলায় যখন অংশ নেন দীপনের জাগৃতি নিয়ে, তখন ভেবেছিলেন প্রকাশকদের এই মহাযজ্ঞে দীপন থাকবেন পুরো মেলা জুড়ে৷ তাঁর স্মারক থাকবে৷ অথচ সেই মেলায় জাগৃতির সেই স্টল ছাড়া কোথাও দীপনের নাম উচ্চারিত হয়নি একবারের জন্যও৷ স্টলে প্রতিবাদ জারি রাখতে দীপনের স্মারক রেখেছিলেন জলি৷ সেই সময় দীপনের বন্ধুদের সঙ্গে পাশে ছিলেন প্রিয়মুখ প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদ ফারুক শুভ৷ বন্ধুরাই একদিন টিএসসি থেকে দোয়েল চত্ত্বর পর্যন্ত দীপন হত্যার বিচার চেয়ে ব্যানার লাগিয়ে দিলেন৷
এরপরের পথচলা দীপনপুর আর জাগৃতিকে নিয়ে একসঙ্গে৷ আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংঘ আইপিএ দীপনকে সম্মানিত করেছে ২০১৮ সালে৷ শারজায় অনুষ্ঠিত পাবলিশার কনফারেন্সে রাজিয়া রহমান জলি ৩১ অক্টোবরকে বিশ্ব প্রকাশক দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন৷
বাংলাদেশেও তাঁর প্রত্যাশা ছিল অনেক, ভেবেছিলেন দীপনের নাম উচ্চারিত হবে প্রতিটি স্থানে গর্ব ও অহংকারে৷ দাবি জানিয়েছিলেন, শাহবাগ আজিজ সুপারমার্কেটের সামনের সড়কটি দীপনের নামে হোক৷ হয়নি বলে হাল ছেড়ে দেননি তিনি৷ জঙ্গি হামলায় নিহত একজনের নাম নিতেও ভয় পান তাঁর আশেপাশের মানুষেরা৷ কিন্তু তিনি জারি রেখেছেন তাঁর লড়াই৷ এবার দীপনের জাগৃতি বরাবরের মতো মাথা উঁচু করেই মেলায় আসছে৷