‘তুফান’-এর সাফল্যে ঢাকাই চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ-দর্শন
শাকিব খান অভিনীত ‘তুফান’ ছবির সাফল্যে ঢালিউডে আবার সুবাতাস বইছে৷ কিন্তু বছরে এমন দু-একটি ব্যবসাসফল ছবি কি চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যথেষ্ট? মুম্বই চলচ্চিত্রের দাপটে টিকে থাকার লড়াইয়ের জন্য কতটা প্রস্তুত ঢালিউড?
চাই বছরে ১০টি ‘তুফান’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে, ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তুফান’ রমরমিয়ে ব্যবসা করছে৷ স্টার সিনেপ্লেক্স কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ ডিডাব্লিউকে জানান, তাদের সাত শাখায় একদিনে এর রেকর্ডসংখ্যক ৫৬টি শো চলেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘হিন্দি ও ইংরেজির চেয়ে বাংলা সিনেমার দর্শক এখন বেশি৷ ‘তুফান’-এর মতো বছরে ১০টি ছবি ব্যবসাসফল হলে হলিউড ও বলিউডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র ভালো অবস্থানে যেতে পারে৷’’
অসম লড়াই
ঢালিউডে (৫ থেকে ১০ কোটি টাকার) বিগ বাজেটের সিনেমা তৈরি হলেই বলিউড ও দক্ষিণের তুলনা টেনে আনা হয়৷ ‘তুফান’-এর ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে সেটা বেশি ঘটেছে৷ কিন্তু ভারতে বড় ক্যানভাসের ছবি নির্মাণের গড় বাজেট ২০০ কোটি রুপি৷ সর্বোচ্চ ৬০০ কোটি রুপি খরচের নজিরও আছে৷ কলকাতায় বড় বাজেটের ছবির বাজেট ৬ থেকে ২৫ কোটি রুপি৷
তিন বছরের সাফল্যের খতিয়ান
একঝাঁক তরুণ নির্মাতার হাত ধরে গত তিন বছরে প্রেক্ষাগৃহে মধ্যবিত্ত দর্শকের জোয়ার ফিরেছে৷ বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি লক্ষণীয়৷ তবুও হিট ছবির সংখ্যা ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘রাজকুমার’ ও ‘তুফান’ মিলিয়ে ১০টিও হবে না৷ অথচ বলিউড ও দক্ষিণে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ২৪টি ছবি ব্লকবাস্টার ও হিট হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গেও চলতি বছর কমপক্ষে পাঁচটি ছবি ভালো ব্যবসা করেছে৷
ঈদ-কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র শিল্প?
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য বছরে এক-দুটি ব্যবসাসফল সিনেমা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘শুধু দুই ঈদের ওপর চলচ্চিত্র শিল্প দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না৷ আমরা চালানোর মতো ভালো ছবি পাই না বলে বছরের অন্যান্য সময় প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখতে হয়৷’’
শুধু ঈদের সময়ের সিনেমা হল!
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, একসময় দেশে ১,৪৬০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল৷ এখন ঈদে সিনেমাপাড়া কিছুটা জমজমাট হলেও বছরের বাকি সময়ে মাত্র ৫০টি সিঙ্গেল স্ক্রিন ও মাল্টিপ্লেক্সের ৩৫টি প্রেক্ষাগৃহ চালু থাকে৷ গত তিন বছর ধরে শাকিব খানের ছবি শুধু ঈদেই মুক্তি পাচ্ছে৷ তাই ঈদে শতাধিক প্রেক্ষাগৃহ চালু থাকে৷ অন্যদিকে ভারতে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ৯ হাজারের মতো৷ পশ্চিমবঙ্গে আছে তিন শতাধিক সিনেমা হল৷
বলিউডে ভর করে ‘বাঁচার’ চেষ্টা
দেশীয় ছবি মুক্তি কমে যাওয়ায় হল মালিকদের দাবির মুখে গত বছর থেকে বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা আমদানি হচ্ছে৷ শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ বাংলাদেশে আমদানি করা প্রথম হিন্দি সিনেমা৷ শাহরুখের ‘জওয়ান’ চললেও আর কোনো হিন্দি ছবি বাংলাদেশে ভালো ব্যবসা করতে পারেনি৷ পশ্চিমবঙ্গের হল মালিকেরাও অস্তিত্ব রক্ষার্থে বলিউডের ছবি চালাচ্ছেন৷ দুই বাংলার প্রেক্ষাগৃহই টিকে আছে অনেকটা বলিউড ও দক্ষিণী সিনেমার ছায়ায়৷
এক দশকের পরিসংখ্যান
ঢালিউডে গত এক দশকে বছরে গড়ে ৫০টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে৷ এরমধ্যে উদাহরণ সৃষ্টির মতো ব্যবসা করেছে গড়ে দুই-তিনটি ছবি৷ পশ্চিমবঙ্গে বছরে ছবি মুক্তির সংখ্যা গড়ে অর্ধশত৷ এরমধ্যে বড়জোর গোটা দশেক ছবি হিট হয়৷ অন্যদিকে বলিউড ও দক্ষিণে তামিল-তেলুগুসহ একেকটি ভাষায় বছরে শতাধিক ছবি মুক্তি পাচ্ছে৷ সেগুলোর মধ্যে অন্তত ৫০ কোটি রুপি ব্যবসা করা ছবি বছরে পাওয়া যায় ১০টিরও বেশি৷
সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া নায়ক
ঢালিউডে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শাকিব খান সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া নায়ক৷ ছবিপ্রতি এখন কোটি টাকা হাঁকছেন তিনি৷ ঈদে ছবি মুক্তি পেলে আরও বেশি সম্মানী নেন৷ বাকিদের পারিশ্রমিক ৫-১০ লাখ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে৷ অন্যদিকে ফোর্বসের তথ্যানুযায়ী, বলিউড ও দক্ষিণে ৬০ থেকে ২৫০ কোটি রুপি পর্যন্ত পারিশ্রমিক পান শাহরুখ খান, রজনীকান্ত, থালাপতি বিজয়, প্রভাস, আমির খান, সালমান খান, কমল হাসান ও অক্ষয় কুমার৷
সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া নায়িকা
ঢাকাই সিনেমায় এখন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া নায়িকা শবনম বুবলী৷ ছবিপ্রতি ১০ লাখ টাকা নেন তিনি৷ এরপরই বিদ্যা সিনহা মিম ও পূজা চেরির অবস্থান৷ একসময় মাহিয়া মাহি ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন৷ ফোর্বসের হিসাবে, বলিউড ও দক্ষিণে ৮ কোটি থেকে ৩০ কোটি রুপি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন দীপিকা পাড়ুকোন, কঙ্গনা রানাউত, ক্যাটরিনা কাইফ, আলিয়া ভাট, কারিনা কাপুর খান, তৃষা কৃষ্ণান, নয়নতারা, বিদ্যা বালান, আনুশকা শর্মা ও শ্রীনিধি শেঠি৷
আন্তর্জাতিক পরিবেশকদের অসন্তুষ্টি
শুধু ঈদকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে বিদেশে বাংলাদেশের ছবি এগোতে পারছে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক পরিবেশকরা৷ স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সৈকত সালাহউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানসম্পন্ন ছবি নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রচারণা চালানো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য প্রযোজকরা এখনও সেভাবে প্রস্তুত নন৷ তাদের আরও পেশাদার হতে হবে৷ সারাবছর ছবি মুক্তি দিতে হবে৷’’
স্টুডিওর চালচিত্র
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে ইদানীং ছবির শুটিং হয় কালেভদ্রে৷ এফডিসির সেই জৌলুস আর নেই৷ এটি ছাড়া ঢাকায় শুটিং স্টুডিও নেই বললেই চলে৷ একসময়ের বারী স্টুডিও বিলীন হয়েছে অনেক আগে৷ অন্যদিকে ভারতে এখনো স্টুডিওর সংখ্যা অনেক৷ এ তালিকায় উল্লেখযোগ্য রামোজি ফিল্ম সিটি, প্রসাদ স্টুডিওস অ্যান্ড ফিল্ম ল্যাবস, যশরাজ স্টুডিওস, মেহবুব স্টুডিও, মুম্বাই ফিল্ম সিটি প্রভৃতি৷ কলকাতায় এই সংখ্যা গোটা দশেক৷
অপ্রতুল ফিল্ম ইনস্টিটিউট
সব দেশে চলচ্চিত্রের দক্ষ কলাকুশলী সৃষ্টির বিষয়ে ভূমিকা রাখে ফিল্ম ইনস্টিটিউট৷ কিন্তু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কার্যক্রমকে সেদিক দিয়ে আহামরি বলা যায় না৷ ভারতে খ্যাতনামা ফিল্ম ইনস্টিটিউট নেহায়েৎ কম নয়৷ এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, চেন্নাইয়ের এল ভি প্রসাদ ফিল্ম অ্যান্ড টিভি অ্যাকাডেমি৷