তিলোত্তমা নগরী কবে হবে ঢাকা?
৩১ জুলাই ২০১৮তীব্র যানজট, একটু বৃষ্টিতেই পুরো শহর ডুবে যাওয়া, গাড়ির হর্ন, ধুলা, এমন হাজারো কষ্টের শহর ঢাকা৷ কিন্তু তারপরও দেশের জনসংখ্যা না বাড়লেও ঢাকার জনসংখ্যা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ কেন?
৬৪ জেলার দেশ বাংলাদেশ৷ সবশেষ আদমশুমারি বলছে, মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির একটু বেশি৷ অথচ, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকা শহরেই বাস করছেন প্রায় ২ কোটি মানুষ৷
সম্পদের চেয়ে জনসংখ্যা যখন বেশি হয়ে যায়, তাকেই বলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ৷ পুরো দেশের হিসেবে সে আশংকা আপাতত বাংলাদেশ ঠেকাতে পারলেও, ঢাকা কিন্তু বিশ্বব্যাপী এখনও উদাহরণ হয়েই আছে৷
নাগরিকদের সঠিকভাবে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনে৷ কিন্তু তাতে যে কোনো লাভই হয়নি, সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে এবারের বর্ষায়৷ সড়কে নৌকার চলাচল রীতিমতো ঢাকার সেবা ব্যবস্থাকে পরিণত করেছে কৌতুকের সামগ্রীতে৷
একদিন জনসংখ্যা নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো ভারতের এক সাংবাদিকের সাথে৷ ঢাকাকে তিনি দিল্লির সাথে তুলনা করলেন৷ পত্রিকা দেখে পরিবেশ ও সেবা সংক্রান্ত যে খবরগুলো পাওয়া যায়, তাতে নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছিলাম ঢাকার অবস্থা দিল্লির মতো এতোটা খারাপ হয়নি এখনও৷
তিনিও মেনেই নিয়েছিলেন আমার কথা৷ কিন্তু একটু পরেই মোবাইল ফোন ঘেঁটে তিনি জানালেন, জানো ঢাকা আর দিল্লিতে জনসংখ্যার এই মুহূর্তে কি অবস্থা?
দেখা গেলো, দিল্লিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ১১ হাজার তিনশ মানুষ৷ আর ঢাকায়? আন্দাজ করুন৷ প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার মানুষ!
কেন মানুষ এখনও ঢাকামুখী!
শিল্প বলুন, আর কারখানা বলুন, আর অফিস-আদালতই বলুন, সবকিছুই যখন ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠছিল, তখন থেকেই অনেকে আশঙ্কা করছিলেন, ঢাকা হবে একসময় বসবাসের অযোগ্য৷ দাবি উঠেছিল বিকেন্দ্রীকরণেরও৷ কিন্তু তারপরও কোনো সরকারই তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি৷
ফলে, এখনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঢাকাতেই আসতে হয় মানুষকে৷ সচিবালয়, গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত সব অফিস, আদালত অবস্থিত ঢাকার সব ব্যস্ততম স্থানগুলোতে৷
বড় বড় শিল্প কারখানাগুলো ঢাকার বাইরে স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে অনেক আগে থেকেই৷ কিন্তু আসলেই কি তাই? দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প৷ প্রায় সব পোশাক কারখানাই গড়ে উঠেছে ঢাকার চারপাশ জুড়ে, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ এখন চারপাশ থেকে চেপে ধরেছে রাজধানীকে৷
প্রতিবারই ঈদ বা বড় কোনো ছুটি এলেই পত্রিকার শিরোনাম জুড়ে থাকে, ‘‘অমুক মহাসড়কে এতো মাইল দীর্ঘ যানজট'৷ এর পেছনে সড়ক অব্যবস্থাপনা যেমন দায়ী, ঢাকার চারপাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব শিল্প কারখানাও দায়ী সমানভাবেই৷
সেবা খাতও মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার বড় কারণ৷
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার হুমকি দিয়েছেন ডাক্তাররা গ্রামে না গেলে তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে হবে৷ কিন্তু তাতেও কি কাজ হয়েছে? উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা পাওয়া গেলেও, একটু বড় কিছু হলেই মানুষকে আসতে হয় শহরে, এবং তারপর ঢাকায়৷
দেশের একমাত্র সরকারি টারশিয়ারি মেডিকেল হসপিটাল হিসেবে এখনও কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল৷ বাংলাদেশের আনাচকানাচ থেকে সব হাসপাতালের ফিরিয়ে দেয়া রোগীরা এসে ভর্তি হন এখানে৷
সীমিত সম্পদ এবং জনবল দিয়ে এই রোগীদের সেবা তো দূরের কথা, স্থান সংকুলানেই অপারগ ডিএমসি৷ এমন অবস্থার সুযোগ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে দালালদের দৌরাত্ম্য৷
প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে সরকার৷ কিন্তু সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন করতে পারেন, এমন সুযোগ এখনও পৌঁছেনি জনগণের কাছে৷
ডিজিটাল যুগে প্রবেশের দাবি করছে সরকার, কিন্তু হাতের নাগালেই সব সুবিধা রাজধানীতে যতটা নিশ্চিত করা যায়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সেবার তেমন অবারিত প্রবাহ নিশ্চিত হয়নি একেবারেই৷
দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সম্পর্কে সমান ধারণাও এখনও মানুষের মধ্যে নেই৷ কর্মক্ষেত্রেও নেই সমান সম্মান৷ ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকাকেন্দ্রিক অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সীমাহীন আগ্রহও অনেককেই টেনে আনছে রাজধানীতে৷ এদের ৮০ শতাংশই রাজধানীর লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে শত কষ্ট সত্ত্বেও জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন ঢাকাতেই৷
ধেয়ে আসছে বিপর্যয়
অনেক চেষ্টা ও বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও এখনও বাণিজ্যিক, শিল্প ও আবাসিক এলাকাই আলাদা করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ৷ ফলে আবাসিক এলাকায় শত শত স্কুল, বাণিজ্যিক এলাকায় অপরিকল্পিত আবাসনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক হাস্যকর নগরায়ন ব্যবস্থার৷
ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের মতো জোড়াতালির ব্যবস্থা হাতে নিয়ে কোনো রকমে যানজট ঠেকানোর চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু তাতে বরং শহরজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ‘দোতলা যানজট'৷
সেবার অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়ছে এর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব৷
বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় কর্মরত অবস্থায় পানি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করতে যেতে হয়েছিলো কৃষি ভবনে৷ ভূগর্ভস্থ পানির কী অবস্থা, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কথা মাথায় ঘুরলেও সেখানে গিয়ে তো মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা৷
এক গবেষক জানালেন, সাধারণত, প্রতিটি এলাকাতেই ভূগর্ভস্থ পানির এক একটি পকেট থাকে৷ বৃষ্টির পানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপায়ে সে পকেট থেকে তোলা পানি আবার ভরাট হয়৷
কিন্তু ঢাকার পকেটগুলোতে গভীর নলকূপ দিয়ে যে হারে পানি তোলা হচ্ছে, তাতে সে পকেটের পানি আর প্রাকৃতিক উপায়ে রিচার্জ হচ্ছে না৷ বরং গাজীপুর ও অন্যান্য পকেটের পানিও টেনে আনছে ঢাকার মানুষ৷ ফলে ধীরে ধীরে খালি হচ্ছে আশেপাশের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিও৷
আরো বড় বিপদ রয়েছে৷ ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে পকেট খালি হওয়ায় সে স্থান পূরণে মাটির নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ছে সমুদ্রের লবণ পানি৷ এবং সে লবণাক্ততা নাকি এখন অবস্থান করছে গোপালগঞ্জে৷ যে-কোনো মুহূর্তে তা ঢুকে পড়তে পারে ঢাকাতেও৷ একবার সে অবস্থার সৃষ্টি হলে আর কোনোভাবেই লবণ পানি বের করা যাবে না৷ ফলে পুরো দেশের কৃষিতে পড়বে মারাত্মক প্রভাব৷
প্রতিকার জানতে গিয়েছিলাম ঢাকা ওয়াসার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে৷ তিনি কিছু আশার কথা শোনালেন৷ বললেন, শোধনাগার বাড়িয়ে ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা চলছে৷ যমুনার পানি খাল কেটে নাকি নিয়ে আসা হবে ঢাকায়৷
কিন্তু ৫ বছর পরও অবাক হয়ে একদিন দেখলাম আমাকে দেয়া সে ইন্টারভিউয়ের বক্তব্যই তিনি দিয়েছেন আরেক সাংবাদিককে৷ পাঁচ বছরেও বদলায়নি তাঁর আশার কথা৷
ঢাকায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়, এবং কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে স্বল্প জনবল দিয়ে সবার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও৷ বেড়েই চলেছে দিনেদুপুরে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা৷
অর্থনীতির একেবারে প্রাথমিক সূত্র অনুযায়ী যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে যা হওয়ার কথা, তা-ই হচ্ছে, হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম৷ বাজার ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু কাঠামো না থাকায় এর চাপ পড়ছে গ্রামেগঞ্জেও৷ একদিকে, গ্রামের সব কৃষিপণ্য বেশি লাভের আশায় শহরে, বিশেষ করে ঢাকায়, রপ্তানি হওয়ায় দেখা দিচ্ছে সংকট, অন্যদিকে সঠিক দাম না পেয়ে মাথায় হাত কৃষকদের৷
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণেও নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ৷ ঢাকায় আবাসন এখন এক আতঙ্কের নাম৷ বেতনের ৬০ শতাংশ, কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি যেখানে চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে, সেখানে জীবনমান উন্নত করার খুব কম সুযোগই পাচ্ছেন ঢাকাবাসী৷
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এত আলোচনা, সভা-সেমিনার, আশঙ্কা প্রকাশ সত্ত্বেও যাঁরা নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা কেনো কার্যকর কিছু করছেন না? ঢাকা বাঁচাতে কেন এখনই শুরু হচ্ছে না বিকেন্দ্রীকরণ?
অনেকে মনে করেন, এর পেছনে দায়ী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা৷ অর্থনীতি, প্রশাসন, এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটলে, ক্ষমতা যাবে তৃণমূলেও৷
ফলে ঢাকার ক্ষমতা ছাড়তে এই মুহূর্তে রাজি নন কেউই৷ এজন্য প্রয়োজনে হয়তো তাঁরা ঢাকাকেই কোরবানি দিতে রাজি৷
কিন্তু তারপরও স্বপ্ন থেমে থাকে না৷ বাংলাদেশের সংবিধানে আছে জনগণই দেশের সকল ক্ষমতার উৎস৷ ফলে জনগণকেই দাবি তুলতে হবে ঢাকাকে বাঁচানোর৷
ঢাকাকে একসময় বলা হতো তিলোত্তমা নগরী৷ তিলোত্তমা বললেই যে সৌন্দর্য, ভালোবাসার কথা চোখে ভেসে ওঠে, ঢাকা হয়ত সত্যিই একদিন হয়ে উঠবে তেমন সুন্দর, তেমন ভালোবাসায় স্বাগত জানাবে নাগরিকদের৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷