তারুণ্যের কৃষি বিপ্লব
২৯ নভেম্বর ২০১৬আমিরুল ইসলাম আমির ডয়চে ভেলকে বলেন, ‘‘বাবা দরিদ্র কৃষক৷ তাঁকে তার কৃষিকাজে সহায়তা করতে গিয়েই আমার এই কৃষির প্রতি আগ্রহ৷ আমাদের বসতবাড়ি ও ২০ শতক জমিতে এখন নানা ধরণের ফসল ফলাচ্ছি৷ কলা, টমোটো, পিঁয়াজ, হলুদ, সব্জি চাষ করেছি৷ ধানচাষে আমি সফলভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে সম্বর্ধনাও পেয়েছি৷ তারা আমাকে উৎসাহিত করছেন৷ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷''
নিজেদের পর্যাপ্ত কৃষি জমি না থাকায় আমির জমি বর্গা নেন৷ তারপর চাষ করেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমি এরই মধ্যে কৃষির ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়েছি৷ ফলে আমি বীজ, সার ব্যবহারে সঠিক কৌশল জানি, ফলে আমার উৎপাদন বেশি৷ আমি তাই আরো কুষকের সঙ্গে কথা বলছি৷ তাঁদেরও পরামর্শ দিচ্ছি৷ আমি চাইছি পাশাপাশি খন্ড খন্ড জমি একই চাষের আওতায় আনতে৷''
তরুণ এই কৃষক আরো বলেন, ‘‘কৃষিতে আমার এই অংশ গ্রহণ আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটিয়েছে৷ কিন্তু আরো বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন৷ আমি আধুনিক কৃষি ফার্ম গড়ে তুলতে চাই৷ চাই পুরোপুরি আধুনিক পদ্ধতিতে কুষি উৎপাদন এবং বিপণন৷ সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি৷''
চুয়াডাঙ্গা সদরের তরুণ আলিমুজ্জামান ও ফিরোজুল হক এরকমই আরো দু'জন উচ্চ শিক্ষিত তরুণ৷ আলিমুজ্জামান ঢাকার নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছেন আর ফিরোজুল হক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন৷ তাঁরা দু'জন মিলে অংশীদারিত্বে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন তাঁদের কৃষি খামার৷ তাঁরা সেখানে উৎপাদন করছেন মৌসুমি ফল ও শাকসবজি৷
আলিমুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কৃষি আমাদের পারিবারিক ব্যবসা৷ বাবা মারা যাওয়ার পর তাই আমাকে হাল ধরতে হয়৷ কিন্তু আমরা কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছি৷ আমরা উন্নত সার, বীজ আমদানি করে ব্যবহার করেছি৷ আমরা থাইল্যান্ড ও ভারতে গিয়ে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি দেখে এসেছি৷ পরামর্শ নিচ্ছি কৃষিবিদদের৷''
তবে তাঁরা এখন কৃষির বিপণন নিয়েও ভাবছেন৷ চিন্তা করছেন ডাইরেক্ট মার্কেটিংয়ের কথা৷ আর এটা করতে গিয়ে তাঁরা কৃষকদেরও সংগঠিত করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন৷ আলিমুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা কৃষকদের কাছ থেকেও তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বাজারজাত করতে চাই৷ আর তা করতে পারলে কৃষক আগের চেয়ে বেশি দাম পাবেন৷''
বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষিপণ্যের মান নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ তারপরও অর্গানিক কৃষিপন্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা রয়েছে তাঁদের৷ আলিমুজ্জামানের ভাষায়, ‘‘আমরা যদি সুস্থ থাকতে চাই, ভালো ভালো খাবার খেতে চাই, এটা শুধু বললেই তো হবেনা, উৎপাদনটাও আমাদের করতে হবে৷''
এটা বলতে গেলে পুরো বাংলাদেশের চিত্র৷ তরুণ এবং শিক্ষিত তরুণরা পুরো বাংলাদেশের কৃষির চিত্র পাল্টে দিচ্ছে৷ যেমন দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের তরুণরা সমতল ভূমিতে মাল্টা চাষে সফল হয়েছে৷ ঢাকার অদূরে সাভার ও কালিয়াকৈরে সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে তরুণরা৷ রাজশাহীতে আম আর ধানচাষে তাঁরা সূচণা করেছেনন নতুন দিগন্তের৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ৷ এখন কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ৷
সেরককমই আরেক তরুণ রাজশাহীর বাঘা উপজেলার অমলপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলম হোসেন৷ তিনি পাঁচ বছর আগে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ফিলোসফিতে স্নাতক ও মাস্টার্স শেষ করার পর চাকরির জন্য ঘুরেছেন৷ চাকরি পেয়েছেনও, কিন্তু মনের মতো নয়৷ তাই চাকরি না করে বাবার সঙ্গেই পারিবারিক কৃষিকাজ শুরু করেন৷ তিনি এখন একজন সফল এবং ধনী কৃষক৷ তাঁর রয়েছে উন্নত জাতের ধানের চাষ, আম বাগান আর মাছের চাষ৷ তাঁর কৃষি ফার্মে এখন পূর্ণকালীন ২৭ জন কর্মচারী আছেন৷ আর এই কৃষকের মূল মন্ত্র আধুনিকতা ও নতুনত্ব৷ আলম হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এবছররই আমি আম চাষে ট্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করি৷ ট্যাগিং পদ্ধতি হলো, আমের মুকুল থেকে গুটি আসার ৪০ দিনের মধ্যে এক ধরণের বিশেষ পলিথিনে আম ঢেকে দেয়া৷ এর ফলে আম পোকা বা বালাইমুক্ত রাখতে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না৷ কীটনাশকমুক্ত আম, ফরমালিনমুক্ত আম হয়৷আমার আম এখন ইউরোপে রপ্তানি হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ধান চাষের ক্ষেত্রে আমি উন্নত বীজ ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করি৷ কৃষি অফিস কোনো উন্নত জাত উদ্ধাবন করলে আমাকে বীজ দেয় বিনামূল্যে৷ আর আমি ফসল উৎপাদন করে পরে তাদের বীজ ফেরত দিই৷ কৃষকদের আমি নিয়মিত পরামর্শ দেই৷ আর নিজে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিই৷''
প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘চাকরি না করে কৃষক হয়ে ভুল করেননি তো?'' জবাবে বলেন, ‘‘ভুল করিনি, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ এখন আমার যে সচ্ছলতা তা কোনো চাকরি দিয়েই সম্ভব ছিল না৷ আমার নিজের সিংহাসনে আমি নিজেই রাজা৷''
বাংলাদেশ পল্লী ও কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কৃষিক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা দেয়৷ এ পর্যন্ত তারা ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে ঋণ সহায়তা দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে তিন লাখ উদ্যোক্তা আছেন, যারা বয়সে তরুণ এবং নতুন ধরণের কৃষিপণ্য এবং ফসল উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন৷
তরুণরা গোলমরিচ, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, টমেটো, ড্রাগন, স্ট্রবেরি মাল্টা ও কমলা ফলের মতো নিশ্চিত মুনাফা আছে এমন খাতগুলোতে বিনিয়োগ করছেন৷ তারা কৃষিপণ্য বিপণন এবং কৃষিযন্ত্রপাতির ব্যবসায় এগিয়ে আসছেন৷ তারা মৎস চাষ ও হাস-মুরগী চাষেও এগিয়ে যাচ্ছেন৷
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘‘এখন যারা কৃষিকাজ করেন, তাদের ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষিত৷ আর কৃষি বলতে ধান চাষ বা পাট চাষ বুঝায় না, এর গন্ডি অনেক বড়৷শিক্ষত তরুণরা কৃষিতে প্রবেশ করায় এই খাতটা নতুন রূপ পাচ্ছে, কারণ, নানা সূত্র থেকে সে কৃষি বিষয়ক তথ্য যোগাড় করতে পারে৷ তার কাছে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কৃষির খবর আছে৷ সে সহজেই নতুন কিছু গ্রহণ এবং প্রচলন করতে পারে৷ আর এ কারণেই বাংলাদেশের তরুণদের হাত দিয়ে এখন এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ ধরণের কমলা ম্যান্ডরিনের চাষও হচ্ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তরুণরা বুঝতে পেরেছে কৃষি একটি অর্থকরী খাত৷ তাই সে কর্মসংস্থানের জন্য এই খাতকে বেছে নিয়ে তার উদ্ভাবনী জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছে৷ মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে৷ আর তরুণরা সেই জায়গা ধরে নতুন ফসল ও ফলের উৎপাদনে যাচ্ছে৷''
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ হলো, এখন কৃষিকাজে এই তরুণরা সাধারণভাবে প্রচলিত কৃষি নয়, তারা যা করেন, তা ব্যতিক্রমী কিছু৷ তাদের বেশিরভাগই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী৷ তারা কৃষিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করছেন৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কৃষি জটিল এবং বাণিজ্যিক হচ্ছে৷ কৃষি এখন অর্থ আয়ের খাতে পরিণত হচ্ছে, যা তরুণদের আকৃষ্ট করছে৷ এটা কৃষির একটি ঐতিহাসিক বাঁক পরিবর্তন৷ এটা হতেই হবে৷ পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে৷ আর তা দিতে পারে কৃষি৷ তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন কৃষক৷ তরুণরাই সেই জায়গা নিচ্ছে৷ তারা কৃষিকে দেখছে বাণিজ্যিক দিক থেকে৷ আর এরাই বাংলাদেশের কৃষিকে নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘কৃষিপণ্যের চাহিদা সবখানেই বাড়ছে৷ আর তা সম্ভাবনার নতুন নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে৷ তরুণরা সেটা বুঝতে পারছে৷''
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক কে এস মুর্শিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তরুণরা উদ্যমী এবং সৃজনশীল৷ তারা কৃষিখাতে আধুনিক পদ্ধতি এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছে৷ তারা প্রচলিত ধারার কৃষি নয়, নতুন ধারা এবং নতুনত্বে বিশ্বাসী৷ ফলে তারা প্রচলিত কৃষিকে আধুনিক রূপ দিচ্ছে৷ কৃষিকে তারা দেখছে বিনিয়োগ হিসেবে৷ আর তারা আত্মপ্রকাশ করছে উদ্যোক্তা হিসেবে৷''
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে৷ সেই হারে প্রচলিত ধারার চাকরি বাড়ছেনা৷ একই সঙ্গে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমছে৷ দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশই গ্রামের, কৃষকের সন্তান৷ তাই তারা এখন আর অযথা চাকরির পিছনে না ছুটে কৃষিতেই নতুন চিন্তা আর উদ্যোগ নিয়ে ফিরে যাচ্ছে- যা আশাব্যঞ্জক৷''
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সব্জি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়৷ স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ৷ ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে৷ আর এসব সাফল্যের ধারায় তরুণদের অংশগ্রন নতুন মাত্রা যোগ করছে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা৷
বাংলাদেশের তারুন্যনির্ভর এই কৃষিব্যবস্থা যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফল, তা কিন্তু নয়৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, কৃষিতে নানা ধরণের সহায়তা বাড়ছে, ঋণের সুযোগ বেড়েছে, বেড়েছে কৃষি সহায়তা, তারপরও শিক্ষিত তরুণরা তাদের কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে গিয়ে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ আর তা আরো তরুণকে এই খাতে আসতে উৎসাহিত করেছে৷ তাঁরা মনে করেন, কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক৷ এরসঙ্গে আধুনিক যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি এবং গণমাধ্যম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে৷ আর এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের কৃষি নতুন যুগে প্রবেশ করবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷