ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের যত স্মারক-জাদুঘর
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার হওয়ায় শহিদ হন অনেকে৷ সেই গৌরবময় ইতিহাসকে ধারণ করে এমন বেশকিছু ভাস্কর্য ও জাদুঘর আছে রাজধানীতে৷ ছবিঘরে দেখুন সেগুলোর এখনকার অবস্থা...
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার
ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও বীরত্বের প্রতীক কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার৷ প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি এখানে ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় জাতি৷ সারাবছর বেদীটি পড়ে থাকে অবহেলায়৷ এর চত্বরে এখন ধুলোবালি আর ময়লা লেগে আছে৷ শহিদ মিনারের নকশা করেছেন শিল্পী হামিদুর রহমান৷ ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন শহিদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম৷ ১৯৮৩ সালে কিছুটা বিস্তৃত করে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়৷
আমতলার ঐতিহাসিক গেট
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান আমতলা গেট এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এলাকা৷ অনাদরে ফটকের ওপরের দেয়ালে রাখা সাইনবোর্ড ঝুলে পড়েছে৷ একপাশে ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পটভূমি ব্যানার দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ফটক দিয়ে ১০ জনের খণ্ড দলে মিছিল করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙেন৷ প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি ফটকটি দিয়ে একটি মিছিল বের হয়৷
মোদের গরব
ভাষা শহিদদের সম্মানে বাংলা একাডেমি ভবনের সামনে রয়েছে ‘মোদের গরব’ ভাস্কর্য৷ এর নকশা করেছেন অখিল পাল৷ ২০০৭ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এটি উদ্বোধন করেন তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ৷ মূল ভিত্তির ওপর আছে ভাষা শহীদ আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান ও আবুল বরকতের ধাতব মূর্তি৷
টেরাকোটায় বাংলা বর্ণমালা
বাংলা একাডেমি ভবনের ‘মোদের গরব’ ভাস্কর্যে একটি উঁচু দেয়াল আছে৷ এর উভয় পাশে দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা নকশা৷ পেছনের অংশে একজন মায়ের কোলে শহীদ সন্তানকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ এছাড়া টেরাকোটায় লেখা আছে বাংলা বর্ণমালা এবং ‘মা’ শব্দটি৷ এর নীচে দুই পাশে দুটি শিশু বই পড়ছে, মাঝে মা ও তার শিশু সন্তান৷ মোদের গরব ভাস্কর্যটির গোলচত্বরে আছে নানান রঙের ফুল৷
জননী ও গর্বিত বর্ণমালা
ঢাকার পরীবাগে ‘জননী ও গর্বিত বর্ণমালা’ ভাস্কর্যের নীচের অংশ এখন বিবর্ণ৷ নামফলকও মলিন হয়ে গেছে৷ চারদিকে ময়লা-আবর্জনা৷ ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এটি উন্মোচন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন৷ এর নকশা করেছেন শিল্পী মৃণাল হক৷ ভাস্কর্যটিতে একজন মা তার শহিদ সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার সামনে একটি সবুজ বৃত্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কয়েকটি বাংলা বর্ণ৷ পেছনে লাল বৃত্ত এবং ‘২১’ সংখ্যা ও কয়েকটি ব্যঞ্জনবর্ণ৷
অমর একুশে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বিপরীত পাশে চোখে পড়ে ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্য৷ ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমূলক ভাস্কর্যের মধ্যে এটি অন্যতম৷ এর স্থপতি জাহানারা পারভীন৷ ভাস্কর্যে একজন মায়ের কোলে শায়িত সন্তান, পেছনে স্লোগানরত অবস্থায় একজন৷ স্তম্ভসহ এর মোট উচ্চতা ৩৪ ফুট৷ ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাবি’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ এটি উদ্বোধন করেন৷
সবচেয়ে উঁচু শহিদ মিনার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু শহিদ মিনার৷ ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের বছর বিবেচনা করে এর ব্যাস ৫২ ফুট ও উচ্চতা ৭১ ফুট৷ দেশভাগ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাইলফলক আটটি বছরের স্মরণে ভিত্তিমঞ্চে রয়েছে আটটি সিঁড়ি৷ ত্রিভুজাকৃতির এই স্থাপত্য নকশা করেছেন রবিউল হুসাইন৷ চত্বরে রয়েছে হরেক রকম ফুল গাছ৷ ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মিনারটি উদ্বোধন হয়৷
চেতনায় একুশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনের দেয়ালে আছে ম্যুরালচিত্র ‘চেতনায় একুশ’৷ এতে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান, আবুল বরকত ও রফিক উদ্দিনের অবয়ব রয়েছে৷ আঁকা হয়েছে শহীদ মিনার ও কয়েকটি বাংলা বর্ণ৷ এটি সাজিয়েছেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এম. এ. আযীয৷ ২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন৷
ভাষা শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর
পলাশী মোড়ের উত্তর পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রবেশপথের বাম দিকে ভাষা শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর৷ আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র৷ জাদুঘরে তার লেখা চিঠি, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, মরণোত্তর একুশে পদক, ডিগ্রি সনদ ছাড়াও ভাষা আন্দোলনের নানা সংগ্রহ আছে৷ ২০১২ সালের ১২ মার্চ এটি উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক বিচারপতি হাবিবুর রহমান৷
শহিদ রফিক-জব্বার হল
ভাষা শহিদ রফিকউদ্দিন আহমদ ও আবদুল জব্বারকে সম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম ছাত্রাবাসের নামকরণ হয় ‘শহীদ রফিক-জব্বার হল’৷ ২০১০ সালের ৪ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষক সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আহমেদ৷ এতে ৭০০টির বেশি আসন আছে৷
শহিদ সালাম-বরকত হল
ভাষা শহিদ আবদুস সালাম ও আবুল বরকতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ হয়েছে শহিদ সালাম-বরকত হল৷ এর মূল ফটকের একপাশে দুই ভাষা শহিদের প্রতিকৃতি রাখা হয়েছে৷ ১৯৮৪ সালে জাবির তৃতীয় বৃহত্তম হলটির যাত্রা শুরু হয়৷ ১৯৮৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভায় এর নাম রাখা হয় ‘শহিদ সালাম-বরকত হল’৷
অমর একুশে হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অমর একুশে হল৷ তবে এখন মূল ফটকের নামফলক ঢাকা পড়ে আছে ছাত্রলীগের ব্যানারে৷ চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভবন নিয়ে অমর একুশে হল৷ এগুলোর নামকরণ হয়েছে ভাষা শহিদ আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুস সালাম ও আবদুল জব্বারের নামে৷
ভাষা-আন্দোলন জাদুঘর
বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দোতলায় রয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর৷ ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ চারটি কক্ষে রাখা হয়েছে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ, বিভিন্ন রচনার অংশবিশেষ, বিভিন্ন পত্রিকার সংখ্যা ও অসংখ্য আলোকচিত্র৷ একটি কক্ষে আছে ভাষা শহিদ শফিউর রহমানের ব্যবহার করা কিছু জিনিসপত্র ও শহিদ আবুল বরকতের বিভিন্ন পরীক্ষার সনদ৷ জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত৷
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে অবস্থিত ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ’ ম্যুরালটি৷ এতে শহিদ মিনার, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান ও বাংলা বর্ণমালা গুরুত্ব পেয়েছে৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পটভূমিও রয়েছে৷ ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য৷ ম্যুরালটি তৈরি করেছেন চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী মো. গোলাম রসূল সোহাগ৷