ডিভোর্স – কেন? বিয়ে টিকিয়ে রাখার উপায়ই বা কী?
অনেকের কাছে ‘বিয়ের’ দিনটি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও স্মরণীয় দিন হলেও ডিভোর্সের হার দিনদিন বেড়ে চলেছে, প্রায় সর্বত্রই৷ কিন্তু কী কারণে? ডিভোর্সের হার কমানোর কোনো উপায় আছে কি?
ডিভোর্সের কারণ
সুখে, দুঃখে সারাজীবন একে-অপরের সঙ্গী থাকা – সেকথা ভেবেই তো বিয়ে! কিন্তু বিয়ের পর যতদিন যায়, বেরিয়ে আসে দু’জনের মধ্যকার নানা অমিল৷ এগুলোই এক সময় ডিভোর্সের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাবুঝির অভাব, পরকীয়া প্রেম, অতৃপ্ত যৌনজীবন, নির্যাতন, অহংকার, সন্তান মানুষ করা নিয়ে মতভেদ, সংসারের কাজে অনীহা ইত্যাদি কারণে তালাক হয় জার্মানিতে৷
কমিউনিকেশন গ্যাপ
২০১৪ সালে জার্মানিতে ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি ডিভোর্স হয়েছে৷ ডিভোর্সের কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই রাখা হয়েছে ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’, অর্থাৎ বিবাহের বন্ধনকে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ করতে যতটা কথাবার্তা ও আবেগ অনুভূতি বা ভালোবাসার প্রকাশ বা আলোচনা দরকার, তা না হওয়াকে৷ এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়, দূরত্ব বাড়ে৷
পরকীয়া প্রেম
দাম্পত্যজীবনের প্রথম শর্তই হলো ‘বিশ্বাস’ আর সেটা যদি না থাকে তাহলে অবশ্যই তা তালাকের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ দাম্পত্যজীবনকে ছেলেখেলা ভেবে অনেকেই অন্য নারী বা পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায় কিংবা পুরনো প্রেমের সম্পর্ককে আবার জিইয়ে তোলে৷ এমনটা হলে স্বাভাবিকভাবেই অপরজনের পক্ষে তা মনে নেওয়া সম্ভব হয় না, ফলে বিয়েটা ডিভোর্সে গিয়ে শেষ হয়৷
যৌনজীবন অতৃপ্ত হলে
শারীরিক ভালোবাসা বা যৌনসুখের দাম্পত্যজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ এই সুখের কমতি বা ভাটা পড়লে অনেকক্ষেত্রেই দেখা দেয় সমস্যা৷ আমাদের দেশে দম্পতিদের শোবার ঘরের এই সমস্যার কথা নিয়ে বাইরে আলোচনা করা না হলেও, জার্মানি বা পশ্চিমা বিশ্বে সরাসরি তা আলোচনায় আসে৷ অতৃপ্ত যৌনসুখের কারণে অনেক সংসারই ভেঙে যায় জার্মানিতে৷
কাজ ভাগাভাগি না করা
চাকরি বা নিজস্ব একটা পেশা এখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই রয়েছে৷ পাশাপাশি বাজার, রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, বাগান করা, আতিথেয়তা, সন্তানদের দেখাশোনা – সংসারের কাজ তো আর কম নয়! এ সব কাজ দু’জনে মিলেমিশে করলে যত সহজে করা সম্ভব, একজনের পক্ষে তা সম্ভব নয়৷ যদি এ সব কাজ শুধুমাত্র একজনকে করতে হয়, তাহলেই দেখা দেয় সমস্যা৷ অর্থাৎ এটাও বিবাহবিচ্ছেদের একটা কারণ৷
আমিই সব
অনেক স্বামী বা স্ত্রী নিজের মতামত বা ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর হবি, আনন্দ, সুখের জন্য যা যা দরকার সবই করেন৷ কিন্তু উল্টোদিকে তাঁর সঙ্গীর সখ বা ইচ্ছার কোনো মূল্যই দিতে চান না৷ ফলে অন্যজনের পক্ষে এই স্বার্থপরতা বা একগুঁয়েভাব বেশি দিন সহ্য করা সম্ভব হয় না৷ ফলাফল – ডিভোর্স! অর্থাৎ একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধবোধ না থাকলে সম্পর্ক বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়!
তালাকের কারণ টাকা
সংসারে প্রয়োজনীয় টাকা অভাবে যেমন তালাক হয়, আবার প্রচুর টাকা থাকলেও বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে৷ দু’টি স্বতন্ত্র মানুষের আলাদা জগত থাকতে পারে, কিন্তু সেই জগত দু’টির একটা মেলবন্ধন জরুরি৷ অতিরিক্ত অর্থ অনেকসময় এটা হতে দেয় না৷ কারণ অতিরিক্ত টাকা-পয়সা কিভাবে সংসার, সন্তান বা অন্য কিছুতে খরচ করা হবে, তা নিয়েও শুরু হতে পারে ঝগড়া৷
‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’
বাড়িতে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতন করাকে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ বলা হয়৷ মানসিক নির্যাতন সেভাবে প্রমাণ করা না গেলেও, শারীরিক নির্যাতন তার প্রমাণ রেখে যায়৷ এই নির্যাতনের স্বীকার হয় সাধারণত নারীরাই৷ এই যন্ত্রণা ও অত্যাচার বেশি দিন সহ্য করা সম্ভব হয় না৷ তাই এ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ডিভোর্সের আবেদন করে থাকেন জার্মানিতে৷
বাংলাদেশে ডিভোর্সের কারণ
২০১৪ সালে শুধুমাত্র ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনেই ডিভোর্সের সংখ্যা ছিল ৫,৪১৮টি৷ বাংলাদেশে ডিভোর্সের হার দ্রুতগতিতে বাড়ার অন্যান্য কারণের পাশাপাশি জি বাংলা, স্টার প্লাসের মতো টিভি চ্যানেল, অতি আধুনিকতা, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবকে দায়ী করছেন ডয়চে ভেলের ফেসবুক বন্ধু মোহাম্মদ নূরসহ বেশ কয়েকজন৷
বিবাহবিচ্ছেদ রোধ করা কি সম্ভব?
সন্তান না হওয়া, বড় কোনো অসুখ, যৌন সমস্যা, অন্য দেশে থাকতে চাওয়ার মতো বিশেষ কারণ হলে হয়ত বিবাহবিচ্ছেদ রোধ করা সম্ভব নয়৷ তবে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ যদি, ভালোবাসা, আবেগ, ভুল বোঝাবুঝি, সন্তান মানুষ করা ইত্যাদি কারণ হয়, তাহলে দু’জন কিছুটা সচেতন ও আগ্রহী হলে বিবাহবিচ্ছেদ আটকানো যেতে পারে৷
সংসার টিকিয়ে রাখতে ভালোবাসার যত্ন
একে-অপরকে নিয়ে খানিকটা ভাবুন, কাজের স্বীকৃতি দিন, সমালোচনা না করে মাঝে-মধ্যে একে-অপরের প্রশংসা করুন, কাজ ভাগাভাগি করে নিন৷ সবচেয়ে বড় কথা দু’জনে মিলে সব কিছু প্ল্যান করুন, আলোচনা করুন আর সে আলোচনায় মাঝে মাঝে সন্তানদেরও সাথে নিন৷ ভালোবাসা গাছের মতো৷ যত্নে ভালোবাসায় তা ফুলে-ফলে ভরে উঠবে৷
ঝগড়া এড়িয়ে চলুন
ডেনমার্কের কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন, যাঁরা খুব বেশি ঝগড়া করেন, তাঁদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি৷ ঝগড়া অবশ্য শুধু ডিভোর্সের কারণই হয় না, মৃত্যুকেও এগিয়ে আনে৷ আর সন্তানের সামনে তো ঝগড়া নয়ই৷ এতে সন্তানের মধ্যে যেমন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, তেমনই কমে যেতে পারে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধও৷
প্রয়োজনে ক্ষমা চেয়ে নিন
ভুল মানুষ করতেই পারে৷ তাই স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেটা একে-অপরকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিন৷ দু’জনে দু’জনের প্রতি বিশ্বাস রাখুন৷ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনোরকম গোপনীয়তা যেন না থাকে৷ তবে তার মানে অন্যের ওপর নজর রাখা কিন্তু একেবারেই নয়৷ অন্যের স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিন৷ ভুলে যাবেন না যে, বিশ্বাসই দাম্পত্যজীবনের মূল ‘চাবিকাঠি’৷