ট্রাম্প বাংলাদেশেকে দেখবে ভারতের চশমায়
৬ ডিসেম্বর ২০২৪পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে কোনো কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করামাত্র তারা মুখস্থ এই জবাবটি দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন৷
আর বিপরীত দিকে এই মন্ত্রণালয়ের যে কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার জন্য এই সময়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকেও যেন অবধারিত একটি প্রশ্ন ছিল—নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে?
নভেম্বরে ট্রাম্প না জিতে যদি কমলা হ্যারিস নির্বাচনে বিজয়ী হতেন, তখনও কি এই প্রশ্নগুলো এতটা জোরালোভাবে উচ্চারিত হতো? হয়ত হতো না৷ এই প্রশ্ন এবং তার জবাবই প্রমাণ করে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে৷ বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ইউনূস সরকারের যে সৌহার্দ্য দেখা গেছে, আগামীতে ট্রাম্পের আমলে অতটা যে হবে না, সেটা উপলব্ধি করছেন সবাই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শীতলতার মাত্রাটা কেমন হবে? এ প্রশ্নের উত্তর কূটনীতিকরা যেভাবে দেবেন, সাধারণ মানুষ সেভাবে ভাববে না৷ ড. ইউনূসকে জো বাইডেন যেভাবে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিলেন, তেমনটি কি করবেন ট্রাম্প? আমার ধারণা, অতি আশাবাদী ব্যক্তিও সেভাবে চিন্তা করেন না৷
হাসিনা সরকারের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতলতম স্তরে নেমে গিয়েছিল৷ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই নানা নেতিবাচক মন্তব্য করতো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তিক্ততা কোনো পর্যায়ে পৌঁছেছিল সেটা বুঝতে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু উক্তি ও সিদ্ধান্তকে স্মরণ করা যায়৷ তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু না কেনার, যুক্তরাষ্ট্রে না যাওয়ার কথা বলেছিলেন৷ হঠাৎ করে একবার নয়, বারবার তিনি এই কথাগুলো বলেছেন৷ বিদেশের একাধিক সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নাকি তাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিতে চায়৷ একবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও এমন অভিযোগ তুলেছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে৷ বাংলাদেশের মতো ছোট একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন একটি অভিযোগ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ছিল বিব্রতকর৷ তাই হাসিনার পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেনের ওই আলিঙ্গন কেবলই ইউনূসের প্রতি ভালোবাসার কারণে, নাকি আগের সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তির আনন্দে—এটা বলা মুশকিল!
ক্লিনটন, হিলারি, ওবামা—এদের সঙ্গে আমাদের ড. ইউনূসের অনেকদিন ধরেই একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে৷ ইউনূসকে যখন নানাভাবে হয়রানি করছিল হাসিনা সরকার, তখন তার এই বন্ধুরা একাধিকবার সংঘবদ্ধ হয়ে বিবৃতি পর্যন্ত দিয়েছেন৷ বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো৷ যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটা দেখা গেছে ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়ে৷
সেবার ট্রাম্পের বিপক্ষে তিনি হিলারিকে সমর্থন করেছিলেন৷ বিষয়টা প্রকাশিতই ছিল৷ এমনকি হিলারির পরাজয়টাও তাকে সম্ভবত ব্যথিত করে থাকবে৷ ২০১৬ সালেই ফ্রান্সের এইচইসি প্যারিস নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখার সময় ডনাল্ড ট্রাম্পের জয়কে ড. ইউনূস ‘সূর্যগ্রহণ' বা অন্ধকার সময় হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন৷ বিষয়টি ট্রাম্পও মনে রেখেছিলেন৷ এ নিয়ে পরে তিনি একবার ড. ইউনূসকে কথার খোঁচাও দিয়েছিলেন৷ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবার জিততে পারেনি, সেই ট্রাম্প আবারও নির্বাচিত৷ আগেরবার ইউনূস ছিলেন কেবলই একজন নোবেল বিজয়ী ক্ষুদ্র্রঋণ ধারণার প্রবক্তা৷ আর এখন বাংলাদেশের সরকার প্রধান৷ ২০১৬ সালে ট্রাম্প-ইউনূস সম্পর্কের কোনো প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়ার কোনো কারণ ছিল না৷ কিন্তু এখন আছে৷ তাই এখন অবধারিতভাবে রিপাবলিকান ট্রাম্পের বিজয় কিছুটা হলেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য৷
এর সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও মোদীর বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে৷ ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গত বেশ কিছুদিন ধরেই ভালো৷ আঞ্চলিক বিচারেই যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে৷ বিষয়টা ভারত নিজেও ভালোভাবে উপলব্ধি করে৷ এ সুযোগটাও তারা নেয় নানাভাবে৷ যেমন গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় অনেকটা ভারতের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ ছিল, শেখ হাসিনার একতরফা নির্বাচনকে দৃশ্যত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল৷ কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তারা যে সেটাকে মন থেকে মেনে নেয়নি, সেটা বোঝা গেছে হাসিনা সরকারের পতনের পর৷
ট্রাম্পের বিজয়ের পর সবাই এখন মনে করছে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ত এবার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠবে৷ এমন চিন্তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে৷ ট্রাম্প ও মোদীর মধ্যকার সম্পর্ক খুব বন্ধুত্বপূর্ণ৷ ২০২০ সালের নির্বাচনের আগে মোদী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে অনেকটা প্রকাশ্যেই প্রচারণা চালিয়ে এসেছে৷ এবার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মোদী যখন অভিনন্দন বার্তা পাঠান, সেখানে তিনি ট্রাম্পকে ‘বন্ধু' হিসাবে অভিহিত করেন৷ ট্রাম্প নিজেও তার একাধিক বার্তায় মোদীকে ‘বন্ধু' হিসাবেই উল্লেখ করেছেন৷ এসব কারণেই হয়ত অনেকে মনে করেন, এখানকার আঞ্চলিক রাজনীতিতে ট্রাম্প আগামী চার বছর ভারতের ওপর তার নির্ভরতা অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে৷ অনেকে আবার এমনও মনে করেন, এ বছরের জুন-জুলাই-আগষ্টে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প থাকলে হয়ত অন্য রকম কিছু হতো৷ আসলেই তা হতো কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু এ ধরনের একটা চিন্তা কিন্তু কেউ কেউ করেন৷
ডনাল্ড ট্রাম্পের একটা বৈশিষ্ট্য আছে, তিনি বিশ্বরাজনীতি বা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লীপনা নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না৷ তিনি সব সময়ই বলেন—‘আমেরিকা ফার্স্ট', এ কারণে ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী চার বছর হয়ত অনেক জায়গাতেই তারা সরাসরি সম্পৃক্ত হবে না৷ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন দেশের উপর নির্ভর করবে৷ এশিয়ার এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে৷ ভারত-পাকিস্তান-চীন-মিয়ানমার-আফগানিস্তান আঞ্চলিক রাজনীতিতে আগের আমলেও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর নির্ভর করতো৷ তবে তারা সবটা ছেড়ে রাখত না৷ কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরাও হস্তক্ষেপ করত৷ যেমনটা বাংলাদেশে শেষ দিকে করেছে৷ এই প্রেক্ষিতটার সম্ভবত এবার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে৷ ধারণা করা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আগামী কয়েকটি বছর ভারতের চশমা দিয়েই দেখবে বাংলাদেশকে৷ বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত যে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সম্ভবত তার প্রতিটা ক্ষেত্রেই সায় থাকবে তাদের৷
ঠিক এই জায়গাটিতে এসেই প্রশ্ন এসে যায়, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা কেমন? এই প্রশ্নে ছোট্ট উত্তর হচ্ছে—'ভালো না৷' তবে এই দুটি শব্দেই আসলে সব বোঝা যাবে না৷ আমার তো মনে হয়, সম্পর্কটা আসলে যথেষ্ট খারাপ৷ এতটা খারাপ নিকট অতীতে কখনো দেখা যায়নি৷ ভারতের মিডিয়াগুলো প্রাণন্তকরণে প্রমাণ করতে চাইছে—বাংলাদেশে এখন সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন চলছে৷ কেবল সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদেরকে খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের শিকার হতে হচ্ছে৷ প্রতিদিন সেখানকার মিডিয়াগুলো এ ধরনের নানা কল্পিত গাল-গল্প প্রচার করছে৷ গদি মিডিয়ার এমন প্রচারে বিস্ময়করভাবে সেখানকার বিরোধী দলগুলো পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ করছে না৷ ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আসলে কেমন, এখানে সংখ্যালঘু হিন্দুরা কোন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কী হচ্ছে না—সে সব বিষয়কে ভারতের চশমা দিয়েই দেখছে বিশ্ব৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে আগে এক্স হ্যান্ডেলে বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটাও কিন্তু ভারতের চশমা দিয়েই দেখা৷ ভারতের মিডিয়াগুলো এখন যা যা বলছে, সেসবেরই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল ট্রাম্পের সেই টুইটে৷ ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ধরনের টুইট কিছুদিন পরপরই দেখা যাবে বলেও ধারণা করেন অনেকে৷
একটা কথা বলা হয়ে থাকে, ‘কূটনীতিতে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ৷’ একথা খুবই সত্য৷ কিন্তু তারপরও কিছু কথা থাকে৷ ব্যক্তিগত সম্পর্ককে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না৷ বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতির কোনো পরিবর্তন না করা সত্ত্বেও ট্রাম্পের আমলে বাইডেনের মতো গুরুত্ব পাবেন না ইউনূস৷ তেমনি বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্পের আমলে অনেক বেশি গুরুত্ব পবেন ভারতের মোদী৷ আর মোদীর এই সময় যেহেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি, তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউনূস সরকার বা তার পরবর্তী কোন রাজনৈতিক সরকারের বাড়তি কোন উষ্ণতা প্রাপ্তির আমি অন্তত কোন সম্ভাবনা দেখি না৷ এখন এমন বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি তৈরি, কীভাবে তার প্রয়োগ করে, ইউনূসের পর কোন রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় বসে, ভারতের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হয়, বিপরীত দিকে ভারতই বা কোন চোখে দেখে আমাদেরকে—সেসব কিছুর উপরই আসলে নির্ভর করছে আমাদের জাতীয় স্বার্থ৷