সেখানে শিবিরের একটা অনুষ্ঠানে বলছিলেন, "গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিজম কায়েমে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা যেটি রেখেছে সেটি হচ্ছে ট্যাগের রাজনীতি। আমাদের দাবি আগামী দিনে কোনো ধরনের ট্যাগিংয়ের রাজনীতি চলবে না।”
সেখানে তিনি ট্যাগের রাজনীতির কিছু নমুনা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, "কথায় কথায় রাজাকার। যাকে রাজাকার বলা হয়েছে তার বাবার জন্ম হয়নি ৭১ সালে। সেই সন্তানকে আপনি রাজাকার বলেন। কথায় কথায় শিবির। কেমন শিবির, যে নামাজ পড়ে সে শিবির। যে দাড়ি রেখেছে সে শিবির, টাকনুর উপরে প্যান্ট পরে এজন্য সে শিবির। সে মেয়েদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করে না সেজন্য শিবির। সে মাদকাসক্ত হয় না এজন্য সে শিবির।"
জাহিদুল ইসলামের এই কথাকে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এর অধিকাংশই সত্য। এগুলো আমরা দেখেছি। এই কথাগুলো জাহিদুল ইসলাম যখন বলেছেন তখন শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। পতনের দেড় মাস পর তিনি বলেছেন এসব কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যখন আওয়ামী সরকার আমলের ট্যাগিংয়ের কথা বলছিলেন, তখনও কি দেশে বিপরীতধর্মী আরেক ট্যাগিং চলছিল না? শিবির নেতার সেই বক্তব্যের পর আরো দুমাস পার হয়ে গেছে। ট্যাগিং প্রবণতা কি কমেছে কিছু মাত্র? আগে বলা হতো চেতনার কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের কথা আর এখন বলা হচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসর বা মদতদাতা—এই সব কথা। শব্দ পাল্টেছে, পক্ষ-বিপক্ষ পাল্টেছে, কিন্তু ঘৃণা বা হিংসার মাত্রা রয়ে গেছে একই রকম।
ট্যাগিংয়ের পরের ধাপটি হচ্ছে মব ভায়োলেন্স। প্রথমে কাউকে একজনকে কিছু একটা বিশেষণে আখ্যায়িত করতে হবে। সেটা সত্য কী মিথ্যা সে বিচার তো অনেক পরের কথা। যাকে ট্যাগিং করা হবে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই দেওয়া হবে না। ট্যাগিং চলতে চলতেই এক পর্যায়ে তাকে করা হবে আক্রমণ! অতি সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা বলি। দু-দিন আগে, ২৮ নভেম্বরের ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চে দুজন বিচারক বিচার কাজ পরিচালনা করছিলেন। হঠাৎ করেই কয়েকজন আইনজীবী সেখানে ঢুকে পড়লেন। চলে গেলেন তারা বিচারকের ডায়াসের সামনে। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারক আশরাফুল কামালকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘‘একজন বিচারপতি হয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে রায়ে রাজনৈতিক ভাষায় বিরূপ মন্তব্য করেছেন। পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আপনি এমনটা করেছেন। ফলে আপনার শপথ ভঙ্গ হয়েছে। বিচারকাজ পরিচালনা করার অধিকার হারিয়েছেন আপনি। আপনি এখনো যদি একই চিন্তা-ভাবনা পোষণ করেন, তাহলে আপনার বিচারকাজ পরিচালনার অধিকার নাই।'' এখানে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির গায়ে ‘রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট' এই ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে রায় দেওয়া হলো যে, সে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবে না! কে করলো? কয়েকজন আইনজীবী! কেবল এই পর্যন্ত করেই ক্ষান্ত হলো না। ট্যাগিংয়ের পরের ধাপ, মব ভায়োলেন্সের প্রদর্শন হলো। একজন আইনজীবী বিচারককে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারলেন!
উচ্চ আদালতের এই ঘটনাটি অতি সাম্প্রতিক। খোদ প্রধান বিচারপতি এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন, সুপ্রিমকোর্ট বারের নেতারা এর প্রতিকারের কথা বলেছেন। এত উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন বলে হয়ত এ নিয়ে কিছু একটা হবে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে কি প্রতিকার কিছু হচ্ছে? প্রতিটি পেশায় এখন ট্যাগিং চলছে, ঢালাও ট্যাগিং। আমি নিজে একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে সমাজে চলমান বিভিন্ন অন্যায়, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা। কিন্তু সেই সাংবাদিকদের সঙ্গেই বা কী হচ্ছে? সন্দেহ নেই, বিগত আমলে সরকারের মোসাহেবি করে কেউ কেউ নানা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, বিপুল অর্থ-সম্পদ লাভ করেছেন। সেরকম কয়েকজন ধরাও পড়েছেন, এখন জেলে আছেন। কিন্তু পাশাপাশি অন্য অনেক সাংবাদিককে যে ঢালাওভাবে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর' হিসাবে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে, তারপর যে যার মতো করে তার বিচারও করে ফেলছে—সেটাকে কীভাবে দেখবেন? কিছু ঘটনার কথা বলি।
জাতীয় প্রেস ক্লাব সাংবাদিকদের একটা প্রাইভেট ক্লাব। হঠাৎ করেই দেখা গেল সেই ক্লাবের অনেক সদস্যের পদ স্থগিত করা হলো। কেন? তারা নাকি স্বৈরাচারের দোসর বা সহযোগী। এই যে ট্যাগ তাদের গায়ে লাগানো হলো, সেটা প্রমাণ করলো কে? কোন আদালতে কোন বিচারক এই রায় দিয়েছেন? অথবা এমন ট্যাগ লাগানোর আগে তাদেরকে কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে? হয়নি। আসলে সেসবের কোনো দরকারও নেই। সময়টাই চলছে এখন এমন। ট্যাগ দিয়ে দিলেই হলো। কে আসবে প্রতিবাদ করতে?
কেবল প্রাইভেট ক্লাবের কথাই বা বলি কেন। সাংবাদিকদের নিয়ে সরকার নিজেও কি সেরকম আচরণ করছে না? দুশ'র মতো সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হলো! কেন? কোনো জবাব নেই। তবে নামগুলো দেখলে বোঝা যায়, তাঁদের সকলকেই তারা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর'—ওই ট্যাগটি অদৃশ্যভাবে লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই কাজটি কি ঠিক হয়েছে? তারা কি সাংবাদিক নন? একটা কথা মনে রাখা দরকার, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য সরকারের কোনো অনুগ্রহ, কিংবা পুরস্কার নয়। এটা সাংবাদিকদের একটা অধিকার। সচিবালয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসে প্রবেশের জন্য এই কার্ডটি লাগে। তাই সরকারের তো উচিত সকল সাংবাদিককেই এই কার্ডটি সরবরাহ করা। কিন্তু বিগত সময়ে দেখা গেছে এই কার্ডটিকে সরকার ব্যবহার করেছে সাংবাদিকদের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে। আগের সরকারগুলোর তুলনায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যদি আমরা তুলনামূলক বেশি গণমুখী মনে করি, তাহলে তো আশা করতে পারি যে এরা আরো বেশি সংখ্যক সাংবাদিককে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেবে। কিন্তু বাস্তবে করছে তারা উলটো কাজ, ঢালাওভাবে তারা বাতিল করেছে দুই শতাধিক সাংবাদিকের কার্ড! এই যে বিশাল তালিকা, এর প্রায় সকলকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তি আছেন যাদের একমাত্র পেশাই হচ্ছে সাংবাদিকতা। এরা অন্য কিছু করেন না। গত তিন দশক ধরে তারা বিভিন্ন মিডিয়াতে চাকরি করেন। যেহেতু তারা বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে কখনোই যুক্ত ছিলেন না, অতএব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনায়াসেই তাদের গায়ে এই সময়ের পপুলার ট্যাগটি লাগিয়ে দেওয়া যায়। সেই সহজ কাজটিই করেছে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়।
আমি কেবল একটা পেশার কথা এখানে উল্লেখ করলাম। এ প্রবণতা কিন্তু চলছে সব ক্ষেত্রেই, সব পেশাতেই। কাউকে শায়েস্তা করতে চান, কেবল একটা ট্যাগ লাগিয়ে দিন। কোনো তথ্য প্রমাণ লাগবে না, কেউ প্রতিবাদ করতেও আসবে না। যাকে ট্যাগ লাগাবেন, সে চিৎকার-চেঁচামেচি করবে, কিন্তু সেটা কেউ শুনবে না। অনেক সময় সে চিৎকার-চেঁচামেচির সময়ও পাবে না, তার আগেই তার বিরুদ্ধে রায় হয়ে যাবে, বিচার কার্যকরও হয়ে যাবে। অন্য কেউ যে প্রতিবাদ করবে, ভয়ে সেটাও পারবে না। কারণ, তখন যে প্রতিবাদ করবে, তার গায়েও ওই ট্যাগ লেগে যেতে পারে। আগে যেমন হুট করেই অপছন্দের কারও গায়ে রাজাকার, রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতিপুতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এসব ট্যাগ লাগানো যেত, ট্যাগ লাগিয়ে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যেতে, তাদের বিরুদ্ধে মব ভায়োলেন্স করা যেত, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ফাঁসিতে পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেওয়া হতো, এখনো সেটা হচ্ছে। এখন কেবল পাল্টে গেছে ট্যাগের শব্দগুলো। বাকি সব রয়ে গেছে আগের মতোই।
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এই ট্যাগিংয়ের দাপট দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি, প্রো-ভিসি, ডিন, রেজিস্ট্রারের মতো বড় বড় পদের ব্যক্তিরা নেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী হওয়ার দায়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেটা দ্রুতই চলে গেছে কলেজ এমনকি স্কুলেও। এখানে অভিযোগ—'ওই ব্যক্তি সরকারি দলের ঘনিষ্ঠ।' অনেক সময় দেখা গেছে ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে ঝামেলা, কিংবা এলাকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ, তখন অবধারিত ফল হিসাবে প্রিন্সিপাল বা হেড মাস্টারকে ট্যাগিং করে টেনে হিঁচড়ে নামানো হয়েছে। আর এই কাজ করানো হয়েছে ছাত্রদের দিয়ে।
আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। গত দুবছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমি কিছুটা সক্রিয়। একটা ইউটিউব চ্যানেল করে সেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমি মতামত প্রকাশ করি। আওয়ামী সরকারের আমলে আমার সেই সব ভিডিও কনটেন্ট দেখে আওয়ামীপন্থীরা আমার গায়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী'—এই ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা করত। এখন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে যখন আমি আমি সরকারের কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করি, পুরোই উলটা দৃশ্য দেখি। কমেন্ট বক্সে আগে যারা ‘চেতনাবিরোধী' বলতো এখন তারা আমাকে ‘দেশ প্রেমিক' বলে। আর আগে যারা ‘দেশপ্রেমিক' বলতো, তাদের কাছে আমি হয়ে গেছি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর'। আর যারা আগে থেকেই আমার ভূমিকার সঙ্গে পরিচিত, তারা একটু ঘুরিয়ে বলে- আমি নাকি কৌশলে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চাচ্ছি। আমার এই সমর্থক অথবা সমালোচকগণ যদি আমার বক্তব্য নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতেন, আমি খুশি হতাম। কিন্তু তারা সেখানেই থেমে থাকেন না। তারা আমার বক্তব্যের আলোকে খোদ আমাকেই ট্যাগিং করেন। কখনো আমি হয়ে যাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদীর অনুচর, কখনো বা বিএনপির দালাল, কখনো বা জামায়াতের দোসর। তাদের কাছে বক্তব্য নয়, ব্যক্তিটাই আসল। ব্যক্তিকে ট্যাগিং করা যায়, বিচার করা যায়, প্রহার করা যায়।
এসব ট্যাগিং প্রবণতা জাতিকে বিভক্ত করছে। এ প্রবণতা নতুন কিছু নয়, আগেও ছিল এখনো আছে। পার্থক্য এতটুকুই—মাত্রাটা বেড়েছে। আগে ভিন্ন দলকে সমর্থন করার ‘অপরাধে' চেয়ার থেকে টেনে হিঁচড়ে কাউকে তেমন একটা নামানো হতো না, ক্লাবের সদস্যপদ স্থগিত করা হতো না, সরকারি অফিসে প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়া হতো না। মাত্রার এই বৃদ্ধি আগামীতে যে কমবে—তেমন আশা করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।