টাইব্রেকারে ব্রাজিলের স্বপ্ন ভেঙে সেমিতে ক্রোয়েশিয়া
৯ ডিসেম্বর ২০২২টাইব্রেকারে যাওয়া ম্যাচে ব্রাজিলের দুটি শট ফিরিয়ে নায়ক পুরো ম্যাচে দারুণ খেলা ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক ডোমিনিক লিভাকোভিচ৷ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে থামাতে হয় যাত্রা, টানা দ্বিতীয়বারের মতো শেষ চারের ঠিকানা খোঁজে উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠে ক্রোয়েশিয়া৷
শুক্রবার কাতারের আল রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে গত আসরের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া৷ নির্ধারিত সময়ের খেলা গোলশূন্য সমতায় থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের দুই অর্ধে দুই দলই পেয়েছিল গোল৷ সমতা ভাঙতে হওয়া পেনাল্টি শ্যুটআউটে স্নায়ু আর ধরে রাখতে পারল না হট ফেভারিট ব্রাজিল৷
টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার চার শটের সবগুলোই জড়ায় জালে৷ ব্রাজিলের প্রথম শট মিস করেন রদ্রিগো, চতুর্থ শট মিস করে বসেন মার্কিনিউস৷ নেইমারের অপেক্ষায় ছিলেন শেষ শটের, কিন্তু সেই সুযোগ আর আসেনি তার৷ হতাশায় নুয়ে পড়েন এই ম্যাচে গোল করে পেলের পাসে নাম লেখানো ব্রাজিলিয়ান তারকা৷
২০০২ বিশ্বকাপের পর থেকেই নকআউট পর্বে বারবারই ব্রাজিলের বাধা হয়েছে ইউরোপের দলগুলো৷ ২০০৬ সালে ফ্রান্স, ২০১০ সালে নেদারল্যান্ডস ও ২০১৮ সালে বেলজিয়ামের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনালে দৌড় থামাতে হয়েছিল ব্রাজিলকে৷ ২০১৪ সালে নিজ দেশে সেমিফাইনালে ব্রাজিলের যন্ত্রণার কারণ হয় জার্মানি৷ ইউরোপীয় দল হওয়ায় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও তাই গত কয়েক বছরের ইউরোপীয় বাধায় অস্বস্তি সঙ্গী ছিল সেলেসাওদের৷ এবারও ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দলের যাত্রা থামাল একটি ইউরোপীয় দলই৷
পুরো ম্যাচে ৪১ শতাংশ বল দখলে নিয়ে গোলের উদ্দেশ্যে মোট ১৯টি শট নেয় ব্রাজিল, যার ১১টি ছিল অন টার্গেট৷ অপরদিকে ৪৪ শতাংশ বল দখলে রাকলেও ৯ শট মেরে কেবল একটি অন টার্গেট রাখতে পেরেছিল ক্রোয়েশিয়া৷ সেই একটা শটেই যে এসেছে গোল৷
বল দখলে নিয়ে শুরুতেই আক্রমণের চেষ্টা চালায় ব্রাজিল৷ পঞ্চম মিনিটে বা দিকে ভিনিসিউস জুনিয়রের নেওয়া দুর্বল শট ধরতে কোনো সমস্যা হয়নি ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক লিভাকোভিচের৷
মাঝমাঠে বল নিয়ন্ত্রণ নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল ব্রাজিলের৷ সুযোগ নিয়ে চেপে বসার চেষ্টা করে ক্রোয়েশিয়া৷
১৩ মিনিটে দারুণ সুযোগ আসে তাদের সামনে৷ ডান প্রান্ত দিয়ে ছুটে গিয়ে ক্রস দিয়েছিলেন মারিও পাসালিচ৷ বক্সের ভেতর এদার মিলিতাওর বাধায় পা লাগাতে পারেননি ইভান পেরিসিচ৷
১৫ মিনিটে বক্সের খানিক সামনে থেকে বল হারিয়ে লুকা মডরিচের পায়ে তুলে দিয়েছিলেন কাসেমিরো৷ আতঙ্ক ছড়িয়ে মদ্রিচ ব্রাজিলের সীমানায় ছুটে গিয়ে যে শট মারেন তা বাধা পায় মিলিতাওর হেডে৷
২০ মিনিটে রিচার্লিসনের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়া করে বক্সে ঢুকে গিয়েছিলেন ভিনিসিউস৷ সৃষ্টিশীল আক্রমণ থেকে রিচার্লিসনের মারা শট আটকে দেন ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডার জোস্কো ভার্ডিওল৷ খানিক পর রিচার্লিসনের দুর্বল শট ধরে নেন ক্রোয়েট কিপার৷
৩০ মিনিটে প্রতি আক্রমণ থেকে বল নিয়ে ছুটে পেরিসিচের নেওয়া শট যায় বারের উপর দিয়ে৷ প্রথম আধঘন্টায় প্রতি আক্রমণে দুরন্ত গতি দিয়ে ব্রাজিলকে চাপে রাখে ক্রোয়েশিয়া৷
বিরতির খানিক আগে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল ব্রাজিলের৷ ৪২ মিনিটে নেইমারের মারা ফ্রি কিক ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক লিভাকোভিচের ধরতে কোন সমস্যাই হয়নি৷ অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা আক্রান্ত হয়ে প্রধামার্থ শেষ করে তিতের দল৷
বিরতির পর নেমে ৪৭ মিনিটেই গোল পেতে পারত ব্রাজিল৷ ডান প্রান্ত থেকে মিলিতাওর বাড়ানো বল যায় বক্সের মধ্যে৷ জটলা থেকে নেইমারের মারা শট শরীর পেতে ব্লক করে দেন ভার্ডিওল৷
৫৩ মিনিটে পেরিসিচের মারা বল থেকে মাথা লাগাতে পারেননি ক্রামারিচ৷ ৫৫ মিনিটে প্রতি আক্রমণ থেকে বা দিকে ছুটে গিয়ে নেইমারের বল দেন রিচার্লিসনকে৷ রিচার্লিসনের বাড়ানো পাস ধরে নেইমারের আড়াআড়ি মারা শট ঠেকিয়ে দেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক৷ ৫৬ মিনিটে রাফিনহাকে তুলে অ্যান্তনিকে নামাম তিতে৷
গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ৬৪ মিনিটে ভিনিসিউসিকে তুলে নিয়ে তার রিয়াল মাদ্রিদ সতীর্থ রদ্রিগোকে নামায় ব্রাজিল৷
৬৬ মিনিটে আরেকটি অসাধারণ সুযোগ হারায় ব্রাজিল৷ ক্রোয়েশিয়ার বক্সে ডিফেন্স ভেঙে ঢুকে পড়া লুকাস পাকেতার শট দারুণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক লিভাকোভিচ৷
৭২ মিনিটে পাসালিচের বদলে ভালিসিচ ও ক্রামারিচের বদলে পেটকোভিচের নামান ক্রোয়েশিয়ার কোচ জাৎকো দালিচ৷
৭৬ মিনিটে ব্রাজিলকে আবার হতাশ করেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক৷ রিচার্লিসনের বাড়ানো বল নিয়ে বা দিক থেকে বল নিয়ে ঢুকে গিয়েছিলেন নেইমার৷ ব্রাজিলের সেরা তারকার নেওয়া শট আবারও ঠেকিয়ে দেন লিভাকোভিচ৷
৮০ মিনিটে আবারও সুযোগ হাতছাড়া হয় লাতিন জায়ান্টদের৷ মিলিতাওর কাছ থেকে ক্রস পেয়ে রদ্রিগো বাড়ান পাকেতাকে৷ বক্সের বাইরে থেকে তার বা পায়ের শট আটকে যায় ক্রোয়েট কিপারের গ্লাভসে৷
৮৪ মিনিটে টুর্নামেন্টে তিন গোল করা রিচার্লিসনকেও তুলে নেন ব্রাজিলের কোচ৷ তার বদলে মাঠে আসেন পেদ্রো৷ শেষ দিকে প্রবল চাপ বাড়ায় ব্রাজিল৷ কিন্তু কোনভাবেই ক্রোয়েশিয়ার গোলমুখ খুলতে পারছিল না তারা৷ গোলরক্ষকের নৈপুণ্যে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে৷
অতিরিক্ত সময়ের শুরু থেকেই একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে ব্রাজিল৷ সেসবের সবগুলোই খেই হারাচ্ছিল ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্সে৷ অতিরিক্ত সময়ের নবম মিনিটে নেইমারের ডান পায়ের বাড়ানো বল নাগালে পাননি ব্রাজিলের কোন খেলোয়াড়৷
১০৩ মিনিটে গোল হজম করে ফেলেছিল ব্রাজিল৷ রক্ষণের ভুলে বল পেয়ে গিয়েছিলেন পেটকোভিচ৷ একদজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ব্রোজোভিচকে দিলেও তিনি বল মারেন অনেক উপরে৷
অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের একদম শেষ মুহূর্তে ব্রাজিলকে আনন্দে ভাসান নেইমার৷ বক্সের বারে থেকে দারুণ মুন্সিয়ানায় পাকেতাকে বল দিয়েই ঢুকে পড়েন নেইমার৷ বক্সে ঢুকে গোলরক্ষকে কাটিয়ে দারুণ শটে বল জড়িয়ে দেন জালে৷ এই গোল দিয়ে ব্রাজিলের হয়ে সবচেয়ে গোল করায় কিংবদন্তি পেলের পাশে বসেন তিনি৷ দুজনেরই গোল এখন ৭৭৷ কে জানত এই মাইলফলক উদযাপনের সুযোগ পরে আর হবে না তার!
শেষ ১৫ মিনিটে মিলিতাওর বদলে আলেক্স সান্দ্রো ও পাকেতার জায়গায় ফ্রেদকে নামান তিতে৷ এবার গোল শোধে মরিয়ে হয়ে উঠে ক্রোয়েশিয়া৷ ১১৭ মিনিটে আসে সফলতা৷ প্রতি আক্রমণ থেকে দারুণ গতিতে বল নিয়ে ছুটে যায় তারা৷ ব্রাজিলের রক্ষণ তখন অনেকটাই অরক্ষিত৷ বদলি নামা মিসলাভ ওরসিচ নিজেদের রক্ষণ থেকে বল কেড়ে ব্রাজিলের রক্ষণে ছুটে গিয়ে পাস দেন পেটকোভিচকে৷ তার শট অ্যান্তিনিওর পায়ে লেগে দিক বদল হয়ে ঢুকে যায় জালে৷ সমতার উল্লাসে মাতে ক্রোয়েটরা৷
খেলার একদম শেষ সময়েও বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ান ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক৷ ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে৷ সেখানেও নায়ক বনেন লিভাকোভিচ৷