জেএনইউ আবার বামদের দখলে
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বিজেপি এবং আরএসএসের৷ চার বছর আগে দেশে সরকার গঠনের পরে সেই স্বপ্ন পূরণে সবরকম চেষ্টা করেছে শাসক দল৷ দেশদদ্রোহীতার অভিযোগে জেএনইউ ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হয়েছে৷ সংসদ পর্যন্ত গড়িয়েছে আলোচনা৷ তবে কাজের কাজ হয়নি৷ হ্যাঁ, অবশ্যই শক্তিশালী হয়েছে এবিভিপি, কিন্তু জোটবদ্ধ বাম শক্তির কাছে নির্বাচনে ধরাশায়ী হতে হয়েছে আবারও৷ বামদুর্গ অটুট রেখে, নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রেখে দিল্লির বুকে বিজেপি ও আরএসএসকে পুণরায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে জেএনইউ৷
অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ কিংবা কংগ্রেস সমর্থিত ছাত্র সংগঠন এনএসইউআইদের কুপোকাত করে ছাত্র সংসদের সভাপতি, সহ সভাপতি, সচিব এবং যুগ্ম সচিব, অর্থাৎ ৪টি শীর্ষ পদেই জয়ী হয়েছেন এসএফআই-আইসা-এআইএসএফ এবং ডিএসএফ-এর বাম জোটের প্রার্থীরা৷ এবিভিপির সভাপতি পদপ্রার্থী ললিত পাণ্ডেকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেছেন আইসার এন সাই বালাজি৷ সহ-সভাপতি পদে জয়ী হয়েছেন ডিএসএফ প্রার্থী সারিকা চৌধুরী৷ সাধারণ সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন এসএফআই-এর এজাজ আহমেদ এবং যুগ্ম সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন এআইএসএফ-এর অমুথা জয়দীপ৷ ৪ টি কেন্দ্রীয় প্যানেল ছাড়াও বাম ছাত্র জোট ‘স্কুল অফ সোশ্যাল সায়েন্স’ এবং ‘স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর ৫ টি আসনেও জয়ী হয়েছে৷ ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বিভাগে বাম ছাত্র জোট ৫টি আসনের মধ্যে ৪ টিতে জয়ী হয়েছে৷ অন্য একটি আসনে জয়ী হয়েছেন এন এস ইউ আই প্রার্থী৷ সবকটি আসনে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে এবিভিপি প্রার্থীদের৷
এদিকে, নির্বাচন পরবর্তী অশান্তি অব্যাহত আছে জেএনইউতে৷ এবিভিপি ও বাম সংগঠনগুলির মধ্যে সঙ্ঘর্ষ লেগেই আছে৷ এর জেরে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন গুরুতর জখম হয়েছেন৷ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সাংবাদিকদেরও ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ মাহি মান্ডবী, ঝিলম হস্টেল, গঙ্গা ধাবা-সহ সর্বত্রই উত্তেজনার আবহ৷
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক কেমন? ডয়চে ভেলে কথা বলেছিল জেএনইউ ছাত্র সংসদের নবনির্বাচিত পদাধিকারীদের সঙ্গে৷ ছাত্র সংসদ সভাপতি এন সাই বালাজি বললেন, ‘‘আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে জেএনইউ-এর ছাত্র সংসদ দখল ছিল গেরুয়া শিবিরের অন্যতম বড় লক্ষ্য৷ যে-কোনো মূল্যে জয় চেয়েছিল তারা৷ এজন্য উপ-রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন এবিভিপি সদস্যরা৷ আসামসহ উত্তর-পূর্বের মুখ্যমন্ত্রীরা প্রচারে এসেছেন৷ ক্যাম্পাসে বিরিয়ানি বিতরণ পর্যন্ত করেছে এবিভিপি৷ শুরু থেকেই এবিভিপি উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে৷’’
বালাজিরা কার্যত লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছেন৷ কিন্তু, কেন? তাঁর জবাব, ‘‘ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গো-হারা হারার পর এবিভিপি-র নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ইস্যু থেকে বেরিয়ে গিয়ে জেএনইউ জুড়ে তুমুল অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে৷ বাম ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের তুলে নিয়ে গিয়ে বেদম পেটাচ্ছে৷ এপর্যন্ত ১০-১২ জন চিকিৎসাধীন৷ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকেও বাদ দেওয়া হয়নি৷ পুলিশের সামনেই আমার গায়ে হাত দিয়েছে ওরা৷ এমনকি ছাত্র সংসদের প্রাক্তন নেত্রী গীতা কুমারীকেও মারধর করেছে তারা৷ এতকিছুর পরেও কোনো কাজ না হওয়ায় এখন নানাভাবে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ স্বভাবতই স্বস্তিতে নেই নির্বাচনে জয়ীরা৷’’
অমুথা জয়দীপ বলেন, ‘‘নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর জেএনইউ-এর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ আগে কেউ কখনো এমন হতে দেখেনি৷ ক্যাম্পাসের ভেতরের রাস্তায় লাঠি হাতে এবিভিপি সদস্যরা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ যাতায়াতের পথে বামপন্থি ছাত্র-ছাত্রীদের ঘিরে ধরে প্রশ্ন করা হচ্ছে, কেন তাদের ভোট দেওয়া হয়নি৷’’ আমুথার আরো অভিযোগ, প্রাক্তন ছাত্র সংসদ সভানেত্রী গীতা কুমারীর সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করা হয়েছে।৷খবর পেয়ে বালাজি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাঁকেও মারধর করা হয়েছে৷ সবটাই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের মদতে৷
সারিকা চৌধুরীর বক্তব্যও একই রকম৷ নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রীর কথায়, ‘‘ফল ঘোষণার পর থেকেই বাম ছাত্রদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে৷ ঘটনা ক্রমশ বাড়তে থাকায় অভিযোগ জানাতে থানায় গিয়েছিলেন সভাপতি বালাজি৷ থানায় বসে আলোচনা করার সময়েই থানা ঘিরে বালাজিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে এবিভিপি৷ তখন আমরা ক্লাস-ক্যাম্পেন করছিলাম৷ খবর আসে বালাজিকে থানায় ঘিরে রেখেছে আরএসএস সমর্থকরা৷ সবাই ক্লাস বন্ধ করে থানার দিকে রওনা হয়েছিলাম৷ রাস্তায় খবর পাই, পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এবিভিপি-র বোঝা উচিত, ডান্ডা দেখিয়ে রাজনীতি সভ্য দেশে হয় না৷ জেএনইউ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, আন্দোলনের জায়গা৷ অশান্তি বরদাস্ত করা হবে না৷’’
তবে এবিভিপি নেতা রমেশ কুমার পালটা অভিযোগ তুলেছেন বাম সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে৷ তাঁর কথায়, ‘‘ভোটে জিতেই আমাদের ধরে ধরে পেটাচ্ছে বামপন্থিরা৷ সুজল যাদবসহ কয়েকজনের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে কমিউনিস্ট ছাত্ররা৷ কয়েকজেনের হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ মোট ৬-৭ জন চিকিৎসাধীন৷ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে৷ সবকিছুর নেতৃত্বে ছিলেন খোদ বালাজি৷’’
এতসবের মধ্যে আবার বিতর্কিত মন্তব্য করেছে জেএনইউ প্রাক্তনী প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ৷ এবিভিপির ভরাডুপি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জেএনইউ এখন ভারতবিরোধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে৷ বাম ছাত্র সংগঠনগুলি কার্যত যেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷ তাঁদের নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা দেখলেই সেটা বোঝা যায়৷’’ সীতারামণের এই মন্তব্যের পর যথারীতি দেশজুড়ে শোরগোল পড়েছে৷