ছোট বেলা থেকেই আমি একটু শুকনা ছিলাম৷ কিন্তু ফুটবল খেলায় যে গোলকিপার হয়, সে কীভাবে ক্রিকেট বলের সাথে উড়ে যাবে-বিষয়টা আমার কোন দিনই মাথায় আসেনি৷
ক্রিকেটের সাথে আমার পরিচয়টাও হঠাৎ৷ ১৯৯৭ সাল তখন৷ বড় ভাইয়েরা রেডিওতে কী যেন শুনছে আর হইচই করে উঠছে৷ নাটক মনে করেই আমি শুনতে গেলাম৷ গিয়ে দেখি, ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে কথা বলছে৷ ক্রিকেট নামটি শুনেছিলাম৷ দুই এক জায়গায় খেলতেও দেখেছি৷ কিন্তু ওইদিনের মত মনোযোগ ক্রিকেট এর আগে আমার থেকে সম্ভবত কোনদিনই পায়নি৷
আকরাম খান, খালেদ মাসুদ পাইলট, হাসিবুল হোসেন শান্ত, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, এমনকি স্টিভ টিকোলোর সাথেও আমার পরিচয় হয় সেইদিনই৷ চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাতের কণ্ঠও প্রথম শুনেছি সেইদিন৷
টিকোলোর ১৪৭ রানের ইনিংস খেলার পর বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচ মোড় নেয় অন্যদিকে৷ শান্তর শেষ বলে রান করা পর্যন্ত উত্তেজনা ছিল মালয়েশিয়ার মাঠ থেকে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে৷ শেষ বলে ক্রিকেট ব্যাট চালিয়ে শান্ত যেন এদেশে ক্রিকেট চর্চার গল্প বদলে দিয়েছিলেন৷ সেবার আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এই দেশে ক্রিকেট খেলতে শুরু করা লাখ লাখ শিশু-কিশোরের একজন ছিলাম আমি৷
এর আগে বাড়িতে কানামাছি থেকে শুরু করে হাডুডু পর্যন্ত সব দেশি খেলা নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকতাম৷ আর খেলতাম ফুটবল৷ হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে খেলেছি র্যাকেটও৷
ক্রিকেট আমাদের কাছে একটা ভিন্ন খেলা৷ এটা পলাপলির মত বাড়ির কোনায় খেলা যায় না৷ মার্বেল খেলার মত দুইজন মিলে শুরু করা যায় না৷ হাডুডুর মত ছোট্ট একটা জায়গায় খেলা যায় না৷ এর জন্য বড় একটা মাঠের দরকার হয়৷ ব্যাট-বল-স্ট্যাম্প কেনারও দরকার হয়৷ যার জন্য চাই টাকা৷ বল কিনলেই হয় না৷ মাঝে মাঝেই ট্যাপ কিনতে হয়৷
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এখানে ২২জন মানুষকে দরকার হয়৷ যে দল ব্যাটিং করতো, তারাই অ্যাম্পায়ারিং করতো৷ সুতরাং এর জন্য আলাদা লোক দরকার হতো না৷
গ্রামের সব জায়গায় এই আয়োজনে ক্রিকেট খেলা হতো না৷ যেখানে হতো, সেখানে থাকত প্রতিযোগিতা৷ কে খেলবে, কে বাদ যাবে-এটা নানা কিছুর উপর নির্ভর করত৷ এমন মাঠগুলোতে খেলতে নামার প্রতিযোগিতার একজন প্রতিযোগী আমিও হয়ে উঠি৷ কিছু প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রায়ই খেলতে নামতাম আমি৷ মাঠে জায়গা না পাওয়ারা থাকত মাঠের বাইরে৷
এরপর একদিন সীমানার কাছাকাছি থেকে এক ক্যাচ ধরতে পারলেও দৌড়ে টাল সামলাতে না পেরে সীমানার বাইরে চলে যাই৷ তখন মাঠের বাইরে থাকা প্রতিযোগীদের একজন শুরু করে, ‘ও বলের সাথে উড়ে যায়৷ বল সামলাতে পারে না’৷
সেই থেকে শুরু৷ ক্যাচ মিস, ফিল্ডিং মিস হলে আমার হালকা-পাতলা শারীরিক গড়ন নিয়ে নানা কথা চলতো৷ এমনকি আমার শরীরের রং নিয়েও কেউ কেউ কথা বলেছে৷ বিষয়টা প্রথম আমি মজা হিসাবেই নিতাম৷ কিন্তু আস্তে আস্তে কথা বলা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং একটা সময়ে এটা আমার মনে বিরক্তি-ভয় ধরিয়ে দেয়৷
অবস্থাটা ধীরে ধীরে এমন হয়ে যায় যে, বাড়ির কাচারির মাঠে আমি যার তুলনায় নিয়মিতই ভালো খেলি৷ বড় মাঠগুলোতে গেলে আমি আর তার কাছাকাছিও খেলতে পারি না৷ এক সময় ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিলাম৷ কালারিজম এবং বডি শেমিং-এই সব শব্দগুলোর সাথে তখনও আমার পরিচয়ই হয়নি৷
আমি কি সেদিন কেবল ক্রিকেট ছেড়েছি? আসলে আরো অনেক কিছু ছেড়েছি৷ ওই সময়ে আস্তে আস্তে ক্রিকেট আরো জনপ্রিয় হয়েছে৷ কানামাছি-হাডুডু খেলার সঙ্গীরাও ক্রিকেটে নাম লিখিয়েছে৷ ফুটবল টিম ভেঙে সবাই ছোটা শুরু করেছে ক্রিকেটের পেছনে৷ বড় মাঠ থেকে বাড়ির উঠান, এমনকি ঘরের ভেতরেও ছেলে মেয়েরা খেলতে শুরু করেছে ক্রিকেট৷ তখন একটা ছেলে ক্রিকেট ছেড়ে খেলার সময়ে কী করত৷
সে আসলে খেলাধুলা থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে৷ বন্ধুরা যখন খেলছে, তখন হয়ত একাকীত্ব ঘোচাতে সে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ নিয়ে বসেছে৷ এক পর্যায়ে দেখলাম,মুরুব্বিরা সবাই খেলার সময়ে আমার পড়াশোনাকেই উৎসাহ দিচ্ছে৷ কেবল একজন ছাড়া৷ আমার প্রিয় সাত্তার স্যার৷ তিনি বলতেন, তোর তো গ্রোথ হবে না৷ খেলার সময় খেলতে হবে৷ এগুলো অন্য সময়ে পড়তে হবে৷ ডাস ক্যাপিটাল বড় হলেও পড়া যাবে৷
স্যার চলে গেছেন অকালে৷ সেই আমাদের কৈশোরেই৷ স্যারের সেই কথা আমি ভুলেও গিয়েছিলাম৷ জীবনের একটা সময় পর্যন্ত আমার মনে হতো, গায়ের রংয়ের মত উচ্চতাও একটা প্রাকৃতিক বিষয়৷ কিন্তু যেদিন আমি জানতে পারলাম, ছোট বেলা থেকে শিশুর খাদ্য-পুষ্টি-খেলাধুলা-মানসিক বিকাশ ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর তার উচ্চতা নির্ভর করে, সেদিনই আমার স্যারের কথা মনে পড়ে যায়৷
এরপর আরো পরে আমি জানতে পারলাম, খর্বকায়ত্ব একটি রোগের মত বিষয়৷ বাংলাদেশে এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সিলেট অঞ্চলে৷ প্রায় অর্ধেক শিশুই এখানে খর্বকায়ত্বে ভোগে৷ এই নিয়ে সেফ দ্যা চিল্ড্রেন সিলেট অঞ্চলে ‘সূচনা’ নামে একটি প্রকল্পও করছে৷ যে সব কারণে শিশুদের উচ্চতা কম হয়, সেই কারণগুলো প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে এই প্রকল্প৷
এখন আমার মনে হচ্ছে, শৈশবে আমাদের পরিবারে ভাইদের সাথে আমার প্রতি কোন বৈষম্য করা হয়নি৷ যেক্ষেত্রগুলোতে শিশুরা বঞ্চিত হলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে সূচনা প্রকল্প বলছে, সেগুলোতে আমি এবং আমার ভাইয়েরা একই রকম ছিলাম৷ কেবল আমি খেলাধুলাটাই ওদের থেকে কম করেছি৷ এ কারণেই হয়ত আমার উচ্চতা ভাইদের থেকে বেশ কম৷
এই উচ্চতা কম হওয়া আমার বডি শেমিংয়ের আরেকটি কারণ হয়ে উঠেছিল৷ আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুরাও এটা নিয়ে কথা বলেছে৷ আমি কষ্ট পেয়ে চুপ থেকেছি৷
মনিরুল ইসলাম নামে একজন লেখক ‘নারী-পুরুষ বৈষম্য: জীবতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট’ নামের একটি বইয়ে এমন একটি মতামত তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন, নারীদের গড় উচ্চতা পুরুষের গড় উচ্চতা থেকে কম হওয়ার একটা কারণ নারীদের প্রতি হাজার বছরের বৈষম্য৷
এটা যেদিন পড়লাম, সেদিন আমি চমকে উঠেছিলাম৷ আমার কাছে মনে হয়েছিল সত্যিই তাই৷ বডি শেমিং আর কালারিজমের শিকার হয়ে খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে আমার উচ্চতা বৃদ্ধি যদি কমে গিয়ে থাকে, তাহলে হাজার বছর ধরে নারীদের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটা সম্ভব৷
তাহলে সমাজে এত এত বডি শেমিংয়ের ফল এই সমাজকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, আমি আর ভাবতে পারছি না৷
খেলাধুলা না করার ফলে আমার উচ্চতা কম হয়েছে বলে সিদ্ধান্তটি আমার একান্তই অনুমান৷ কিন্তু খেলাধুলা না করলে শিশুর বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটাতো সত্য৷ তেমনি সত্য আমার জীবনে থাকা শৈশবের সেই বডি শেমিংয়ের কালো এক ছায়া৷
এক বডি শেমিংয়ে যদি এত দীর্ঘ কালো ছায়া থাকে, তাহলে সমাজে অনলাইনে অফলাইনের এত এত বডি শেমিংয়ের ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে?