জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা
১৬ এপ্রিল ২০১২জার্মানির ‘ডুয়াল সিস্টেম’এ এটা ব্যতিক্রম নয়৷
দক্ষ কর্মীর চাহিদা
জার্মানিতে পারদর্শী কর্মীর খুবই প্রয়োজন৷ ফলে ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অনেক কোম্পানি অপেক্ষা করতে প্রস্তুত নয়৷ আগেই বিশেষ কিছু পেশার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা চলে৷ অবশ্যই সেসব এমন পেশা, যেখানে সত্যি কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ‘ডুয়াল সিস্টেম' – যার মাধ্যমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়৷ ছাত্রছাত্রীরা যেমন উচ্চশিক্ষার শেষে চাকরি পাবার আশা করে থাকে, প্রতিষ্ঠানগুলিও দক্ষ শ্রমিক ও কর্মীদের জন্য অপেক্ষা করে৷ সেরকম প্রার্থী পেলে কোম্পানিগুলি আগেভাগে তাদের শিক্ষার ব্যয় বহন করে, অনেক সময় আবার বেতনও দিতে শুরু করে৷
অভিনব দান-প্রতিদান
এর বদলে অবশ্য সেই ছাত্র বা ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হয়৷ এতে ফায়দা দুই পক্ষেরই৷ এমনই এক ছাত্রের নাম সেবাস্টিয়ান বুডনিক৷ সে বাণিজ্য ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে৷ জার্মানিতে প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস'এর যে চল আছে, বন শহরের কাছে ব্র্যুল'এও রয়েছে তেমনই এক ‘ফাখহোখশুলে'৷ সেখানেই ভর্তি হয়েছে সেবাস্টিয়ান৷
আজ ক্লাসের বিষয় একটা কোম্পানি চালানোর কৌশলগত দিকগুলি৷ সেবাস্টিয়ান ‘ডুয়াল সিস্টেম'এর কাঠামোয় এই বিষয়টিই বেছে নিয়েছে৷ একদিকে পুঁথিগত বিদ্যা, অন্যদিকে সেই বিদ্যার বাস্তব প্রয়োগ শিখতে চায় সে৷ সেমেস্টারের সময়ও সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে৷ অর্ধেক সময় ক্লাসে, বাকি সময়টা জার্মানির বিখ্যাত সুপারমার্কেট চেন ‘রেভে' গোষ্ঠীতে কাজ করছে সেবাস্টিয়ান৷ তবে ঠিক সাধারণ বেতনভোগী কর্মীর মতো কাজ করে না সে৷ কোম্পানির নিজস্ব মার্কেটিং'এর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বাস্তব জ্ঞান বাড়ানোই তার আসল লক্ষ্য৷ এভাবে কোম্পানিও তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণগত দক্ষতা প্রথমে বাড়িয়ে তারপর তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবে৷
সেবাস্টিয়ান বলছে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা বা পুঁথিগত বিদ্যা মগজে ঢোকানো কোনোকালেই তার লক্ষ্য ছিল না৷ কম সময়ে যতটা সম্ভব জ্ঞান অর্জন করে তা হাতেনাতে কাজে লাগানোর এই সুযোগ পেয়ে সে খুবই সন্তুষ্ট৷
কাজের চাপ ও কঠিন চ্যালেঞ্জ
‘ডুয়াল সিস্টেম'এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ নেই বললেই চলে৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবার জন্য এই কাঠামো কি উপযুক্ত? যারা এই কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত, তাদের মতে বিষয়টি এত সহজ নয়৷ যে ছাত্র বা ছাত্রী একসঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পথে এগোতে চায়, তাকে শুরু থেকেই অত্যন্ত মনোযোগী ও উদ্যমী হতে হবে৷ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন চাপ নেই৷ ছাত্রছাত্রীরা অনেকটাই নিজেদের পছন্দমতো কোর্স বাছাই করতে পারে, দুই সেমেস্টারের মাঝে লম্বা ছুটি উপভোগ করে৷ কিন্তু একবার ‘ডুয়াল সিস্টেম'এ পা রাখলে আরামের সুযোগ কম৷ এমনকি দুই সেমেস্টারের মাঝে ছুটিও পাওয়া যায় না৷ হয় ক্লাসে, না হয় কোম্পানির দপ্তরে সময় কাটাতে হয়৷
এমন চাপের মুখে কিছু স্বাধীনতা খোয়াতে হয় ছাত্রছাত্রীদের৷ সব ক্ষেত্রে তাদের পছন্দ-অপছন্দকে মর্যাদা দেওয়া সম্ভব হয় না৷ যে কোম্পানি তাদের পেছনে এত বিনিয়োগ করছে, তাদের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়৷ যেমন সেবাস্টিয়ান ‘রেভে' গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত৷ তারাই তার টিউশান ফি দেয়, যা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশি৷ তার উপর সে কোম্পানি থেকে প্রশিক্ষণের জন্য স্টাইপেন্ড'ও পায়৷
সবারই লাভ হয়
তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকেও বাড়তি উদ্যোগ দেখানো হয়৷ যেমন সেবাস্টিয়ান যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে, তারা ছাত্রছাত্রীদের একটি গোটা সেমেস্টার বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়৷ শুধু নিজের বিষয়ে দক্ষতা অর্জন নয়, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসা, অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার শিক্ষাও পায় তারা৷ এক বা একাধিক বিদেশি ভাষা শিখতে হয়৷ ছোট ছোট ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বাড়তি নজর দেওয়া হয়৷ ফলে তারা পেশাগত জীবনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারে৷
সেবাস্টিয়ানের শিক্ষকেরাও এই ‘ডুয়াল সিস্টেম'এর উপযোগিতা টের পান৷ কারণ সে তার কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ক্লাসে যেসব প্রশ্ন করে, তার ফলে বাস্তব জগত সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে পড়েন শিক্ষকেরা৷ এই মডেল এত ভালো কাজ করছে, যে জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস'গুলি ‘ডুয়াল সিস্টেম'এর কাঠামো সম্প্রসারণ করে চলেছে৷
প্রতিবেদন: আর্ন্ট রিকমান, সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ