জার্মানিতে রোববার সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলে৷ বাংলাদেশ বা ভারতের সঙ্গে সেই দিনের পরিবেশের কোনো তুলনাই চলে না৷ চারিদিকে রাজনৈতিক দল তথা প্রার্থীদের কিছু হোর্ডিং বা পোস্টার ছাড়া বাইরে থেকে আসা কোনো মানুষের পক্ষে বোঝাই দায়, যে সে দিন দেশের আগামী সরকার গড়ার ভিত্তি স্থাপন করা হচ্ছে৷ নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে সরকার গড়া পর্যন্ত সময়ও রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থী ও নেতাদের কার্যকলাপ অনেকের কাছে ম্রিয়মান লাগতে পারে৷ টিকে থাকার তাগিদ থাকলেও ক্ষমতাসীন সরকার কার্যত কোনো বাড়তি সুবিধাই পায় না৷
হিটলারের নাৎসি জমানার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেডারেল জার্মানির রাজনৈতিক কাঠামো ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের পাঠ্যবই হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, এমনটা বলা অত্যুক্তি হবে না৷ কনরাড আডেনাউয়ার, ভিলি ব্রান্ট, হেলমুট কোল বা আঙ্গেলা ম্যার্কেল চ্যান্সেলর হিসেবে দেশে-বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতি ও প্রভাব রাখলেও তাঁদের হাতে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো অবলম্বন ছিল না৷ প্রায় একটানা জোট সরকারের প্রয়োজনীয়তাও কোনো দলের হাতে ক্ষমতা অপব্যবহারের বিশেষ সুযোগ তুলে দেয় নি৷
এমন পরিবেশে জার্মানির সংবাদ মাধ্যমও দলীয় রাজনীতির চাপ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে মোটামুটি সক্ষম হয়েছে৷ এমনকি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে চালিত ‘পাবলিক মিডিয়া' হিসেবে পরিচিত রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলিরও রক্ষাকবচ রয়েছে৷ জোট সরকারের শরিক দলের নেতাদের ‘মাউথপিস' হয়ে ওঠে নি এআরডি, ডেডডিএফ বা ডয়চে ভেলের মতো সংবাদ মাধ্যম৷ বেসরকারি সংবাদপত্র, পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলির মধ্যে কয়েকটি রক্ষণশীল, বামপন্থি, উদারপন্থি বা পপুলিস্ট ভাবধারার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের সেই চরিত্র পাঠক বা দর্শকদের কাছে অজানা নয়৷ ফলে নির্বাচিত সরকারের সমালোচনা ও চ্যান্সেলরসহ মন্ত্রিদের তুলোধোনা করতে কেউই পিছপা হয় না৷ বিরোধী নেতারাও সমালোচনার সম্মুখীন হন৷ শীর্ষ নেতাদেরও সেই চাপ মেনে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়৷
সোশাল মিডিয়ার রমরমা অবশ্য বর্তমানে জার্মানির এই ঈর্ষণীয় কাঠামোর ভিত্তি নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ করোনা মহামারি থেকে শুরু করে শরণার্থী সংকট অনেক মানুষের কাছে মূল স্রোতের ‘দায়িত্বশীল' সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে৷ ‘ফেক নিউজ' ও ‘কনস্পিরাসি থিওরি' আঁকড়ে ধরে তারা প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমকে আর বিশ্বাস করছে না৷ এমন মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার অভাবের ফায়দা তুলতে এগিয়ে আসছে চরম দক্ষিণপন্থি শিবির৷ জনমত সমীক্ষায় এএফডি দল জাতীয় স্তরে দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হয়ে উঠেছে৷ জার্মানির পূবের অনেক রাজ্যে এই দল এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছে৷ যুক্তি, তর্ক, তথ্য-পরিসংখ্যানের বদলে অনেক মানুষ অন্ধ বিশ্বাস, বদ্ধমূল ধারণা, বুকে জমে থাকা ক্রোধ ও ভিত্তিহীন সংশয়কে আঁকড়ে ধরছেন৷
বিশ্বের অনেক প্রান্তের মতো জার্মানিও গণতান্ত্রিক সমাজের ‘শিক্ষিত' মানুষের বোধবুদ্ধির এমন সংকটের মুখে রয়েছে৷ সব জেনেশুনেও সে সব দেশের ভোটারদের একটা বড় অংশ প্রতিবাদী, চরমপন্থি, বিভাজনমূলক, জনমোহিনী রাজনৈতিক শক্তির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন৷ এর পরিণতি সম্পর্কে সংশয় থাকার কথা নয়৷