জার্মানি যে কারণে সভ্য দেশ
১২ জুলাই ২০১৯জার্মানিতে আমার সাত বছর হলো৷ এই সাত বছরে আমার, আমার পরিবার এবং পরিচিতজনদের কম করে হলেও সাতটি ঘটনা তো বলতেই পারি, যেগুলোর মধ্যে পুলিশের কাছে যেতে ভয় পাওয়ার ঘটনা একটাও নেই৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ মনযোগ দিয়ে অভিযোগ শুনেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাও নিয়েছে৷ যেগুলোতে পারেনি, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আশায়ও রাখেনি, হয়রানি করা, ঘুস চাওয়া তো দূরে থাক৷ আমার কিশোর সন্তান সাইকেল খুইয়ে রাতে একা বেশ দূরের পুলিশ স্টেশনে একা গিয়েছে, পুলিশ তার কথাও গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে৷ ভিনদেশ থেকে আসা এক কিশোর নির্ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে পারে এবং কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া, বরং বিচারপ্রার্থী হিসেবে যথেষ্ট সহানুভূতি, সম্মান পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারে— এই হলো জার্মানি৷ পুলিশের ভালো ব্যবহার, কর্তব্যপরায়নতা এখানে কাউকে অবাক করে না, পাঠককে বিস্মিত করতে সাংবাদিকরা এখানে ‘পুলিশের মহানুভবতা' শিরোনামে টুকরো খবর লিখতে বসেন না— এই হলো জার্মানি৷
যে কোনো অপরাধের শিকারের জন্য প্রাথমিকভাবে এই ভরসাটা খুব দরকার৷পুলিশের কাছে গেলে বিপদ আরো বাড়তে পারে জানলে কে যাবে অভিযোগ জানাতে?
শুধু ধর্ষণ-নির্যাতন নয়, সব অপরাধের ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর এই আস্থাটুকু খুব দরকার৷ আর দরকার পাশের মানুষগুলোর সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং পাশে থেকে লড়াইয়ে শামিল না হলেও তারা কথায়-কাজে বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না এমন নির্ভরতা৷ এই জায়গায় জার্মানি এখনো শতভাগ আদর্শ হয়ে উঠতে পেরেছে তা বলা যাবে না৷ এই কয়েকদিন আগেই এক খবরে জানলাম, এ দেশের ঘরে ঘরে পুরুষনির্যাতনও হয়, লোকলজ্জার ভয়ে এ দেশের অনেক পুরুষও বিচার চাইতে পারেন না, তাই জার্মানির দুই রাজ্য বাভারিয়া এবং নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া সম্প্রতি পুরুষ নির্যাতন বন্ধের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
নারীনির্যাতনও হয় এবং পুরুষনির্যাতনের চেয়ে অনেক বেশিই হয় জার্মানিতে৷ শিশুনির্যাতনও হয়৷ গত মাসে ডয়চে ভেলেতেই প্রকাশিত একটি খবরের প্রথম দুটি বাক্য ছিল এমন— ‘‘ জার্মানিতে শিশুদের যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন ও হত্যা বাড়ছে৷ পুলিশ জানিয়েছে, গত বছর সারা দেশে ১০০-রও বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে কয়েক হাজার শিশু৷''
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, জার্মানি এমন স্বর্গ নয়, যেখান থেকে অনেক দূরে থাকে অপরাধী বা অপরাধপ্রবণ মানুষেরা৷এ সমাজেও কিছু মানুষের মাঝে অপরাধরাধপ্রবণতা দেখা দেয়, কিছু মানুষ তার শিকার হয়, কিন্তু দু' পক্ষই জানে সমাজ, পুলিশ, আইন-আদালত কোনোভাবেই অপরাধীর পাশে দাঁড়াবে না৷
পরিসংখ্যান অনেক দেয়া যাবে, অনেক খবর তুলে ধরে দাবি করা যাবে জার্মানিকে অপরাধশূন্য করার লড়াই সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো জিতে যায়নি৷এ লড়াই পুরোপুরি কখনো জেতা যায় না৷ কিন্তু সভ্য দেশে অপরাধীর জন্য শাস্তির ভয় থাকে আর বিচারপ্রার্থীর জন্য থাকে বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা৷ বিশ্বযুদ্ধের লজ্জাজনক অতীত আছে যে দেশের, সেই দেশ কিন্তু আজ সমৃদ্ধ হয়েছে, সভ্যও হয়েছে৷