মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি
৩ জুন ২০১২বিশেষ অভিনব সম্পর্ক
একদিকে অভিনব ঐতিহাসিক কারণে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির দায়িত্ব, অন্যদিকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জার্মানি তথা ইউরোপের স্বার্থ – এই দুই কঠিন মেরুর মধ্যেই বিচরণ করতে হয় জার্মানির শীর্ষ স্তরের যে কোনো নেতাকে৷ প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক'এর ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না৷ তবে সাবেক কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির বিক্ষুব্ধ যাজক হিসেবে তাঁর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ইসরায়েল তথা বৃহত্তর ইহুদি সমাজে সম্ভ্রম কুড়িয়েছে৷
গাউক এমন একটা সময়ে ইসরায়েল সফর করলেন, যখন প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে সেদেশের সরকারের অনেক নীতি আন্তর্জাতিক মহলে মোটেই সমাদর পাচ্ছে না৷ পশ্চিম তীরে অধিকৃত এলাকায় বসতি নীতি পুরোদমে চলছে৷ ফলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া থমকে গেছে৷ ইরানের হুমকির পাল্টা জবাব হিসেবে ইসরায়েল সেদেশের উপর সামরিক হামলার প্রস্তুতি চালাচ্ছে৷
এসব কারণে আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েলের সামগ্রিক ভাবমূর্তিরও ক্ষতি হচ্ছে৷ জার্মানিতেও এক সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষায় একটা বড় অংশ ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন৷ জার্মানির নোবেলজয়ী লেখক গ্যুন্টার গ্রাস ইরানের প্রতি ইসরায়েলের তর্জন-গর্জনের কড়া সমালোচনা করে একটি কবিতা লিখেছেন৷ ইসরায়েল তাঁকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত' বলে ঘোষণা করেছে৷
জার্মানিতে ঐকমত্য
রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিয়ে জার্মানির রাজনীতি জগতের মূল স্রোতে কোনো দ্বিমত নেই৷ হিটলারের নাৎসি আমলে ইহুদি নিধন যজ্ঞে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের অপমৃত্যুর জের ধরেই রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল৷ ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব যখন বার বার সেই রাষ্ট্রকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেবার হুমকি দেয়, তখন দ্বিতীয় ‘শোয়া' বা হলোকস্ট'এর বিপদকে লঘু করে দেখতে পারে না জার্মানি৷ গাউক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ইরানের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্য শুধু যে ইসরায়েলের জন্য স্পষ্ট বিপদ বয়ে আনছে তা নয়, গোটা অঞ্চল এবং ইউরোপে আমাদের জন্যও এটা একটা বিশাল হুমকি৷''
ভারসাম্যের প্রচেষ্টা
মধ্যপ্রাচ্যে জার্মানির পররাষ্ট্র নীতি কিন্তু মোটেই ইসরায়েল-কেন্দ্রিক নয়৷ ইসরায়েলের নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রেখে এক স্বাধীন ও মজবুত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রশ্নে জার্মানির আন্তরিকতার কথা বার বার তুলে ধরেছেন গাউক সহ জার্মান নেতারা৷ ফিলিস্তিনি এলাকা ও আরব জগতের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলে বার্লিন৷
ফিলিস্তিনি এলাকায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে জার্মানির দীর্ঘমেয়াদী কার্যকলাপ চলছে৷ অনেক বছর ধরে ‘অনেস্ট ব্রোকার' হিসেবে বিশেষ আস্থা অর্জন করেছে জার্মানি৷ ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে হামাস বা অন্য কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর গোপন আলোচনা বা দরকষাকষির প্রয়োজন পড়লে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ডাক পড়ে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা বিএনডি'র৷ গাজায় অপহৃত ইসরায়েলি সৈন্য গিলাদ শালিত'এর মুক্তির ক্ষেত্রেও নেপথ্য আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল বিএনডি৷
ফিলিস্তিনি এলাকায় সক্রিয় জার্মানি
বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি এলাকা সফর করেন গাউক৷ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে আলোচনায় তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার আহ্বান জানান৷ ফিলিস্তিনি এলাকায় রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গাউক আব্বাসের ব্যক্তিগত অবদানেরও বিশেষ প্রশংসা করেন৷ হিংসা নয় – একমাত্র সংলাপের মাধ্যমেই যে সাফল্য পাওয়া যায়, আব্বাস নিষ্ঠার সঙ্গে তা বার বার তুলে ধরেছেন, বলেন গাউক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘সংলাপের পথ খোলা রাখতে এবং সংলাপ আবার শুরু করতে আমি প্রেসিডেন্ট আব্বাস'কে উৎসাহ দিচ্ছি৷ ইসরায়েলেও আমি সংলাপের উপর জোর দিয়েছি এবং বিশেষ করে বসতি নীতির ক্ষেত্রে সংযমের ডাক দিয়েছি৷''
ইসরায়েল'এর প্রতি কতটা সংহতি প্রয়োজন?
ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ইসরায়েলে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল'এর ভাবমূর্তি অত্যন্ত উজ্জ্বল৷ ৪ বছর আগে ইসরায়েল সফরে এসে ম্যার্কেল বলেছিলেন, ইসরায়েলের অস্তিত্ব জার্মানির রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷ প্রেসিডেন্ট গাউক কিন্তু এমন মন্তব্য করতে প্রস্তুত নন৷ সাংবাদিকদের কাছে তিনি ম্যার্কেল'এর সঙ্গে এক্ষেত্রে দ্বিমতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন৷
তবে তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হলো, ইসরায়েলের অস্তিত্ব জার্মানির রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়লে ইসরায়েল কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে জার্মানি'কেও তার সামরিক শক্তি নিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে৷ ম্যার্কেল নিজে এমন সম্ভাবনা সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি নন৷ ইসরায়েলের সঙ্গে একযোগে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে গাউক'ও কোনো মন্তব্য করেন নি৷ কিন্তু সব মিলিয়ে জার্মানির প্রেসিডেন্টের ইসরায়েল সফরের ইতিবাচক মূল্যায়ন হয়েছে দুই দেশেই৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়