জামিন নাই, বিচার নাই
নিম্ন আদালত থেকে আপিল বিভাগ। অধিকাংশ মামলায় কেটে যায় দীর্ঘ সময়। একপ্রকার বিনা বিচারের কারা অভ্যন্তরে কাটে অভিযুক্তদের জীবন। রাষ্ট্রের কারণে কারো কারাজীবন দীর্ঘ হলে তিনি কি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন? ছবিঘরে বিস্তারিত৷
১৭ বছরের কারাবাস, এরপর নির্দোষ শিপন
১৯৯৪ সালে ঢাকার সূত্রাপুরের একটি হত্যা মামলায় টানা ১৭ বছর বিনা বিচারে কারাগারে ছিলেন মো. শিপন। তিনি জামিনও পাননি, বিচারও হয়নি। তার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয় এবং ছয় মাসের মধ্যে বিচার শেষ করতে বলে। সেই বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হন শিপন। মাঝখানে হারিয়ে গেছে ১৭টি বছর।
‘অসহায়দের তথ্য উপাত্ত নিশ্চিতে কাজ করা জরুরি’
বিনা বিচারে গ্রেপ্তারদের জামিন নিয়ে কাজ করে লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পার্সন্স (এলএএইচপি) নামে একটি সংস্থা। এর চেয়ারম্যান ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমের মতে, অনেকক্ষেত্রে তদবিরকারক না থাকায় অল্প অপরাধে অনেকে দীর্ঘমেয়াদে কারাগারে থাকেন। এদের অসহায়ত্বে অনেকাংশে ন্যায় বিচার ব্যাহত হয়। এই অসহায়দের তথ্য উপাত্ত নিশ্চিতে কাজ করা জরুরি।
‘জামিনে ফ্যাক্ট কতটুকু দেখে ডাউট আছে’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাউজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘‘নীচের কোর্টে এত এত ক্রাউড, সেখানে জামিনের আবেদন কতটুকু ফ্যাক্ট দেখে করে, সেটা আমার কাছে অনেক সময় সন্দেহ হয়। হাইকোর্ট একটা জামিনে আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টাও শোনে। সেখানে আমরা তথ্য প্রমাণ সাইটেশন দিতে পারি। নীচের কোর্টে এই সুযোগ কম। এটা কেবল বাংলাদেশেই না। নিউ ইয়র্কের নাইট কোর্টেও আমি একই অবস্থা দেখেছি।’’
আইনজীবীরা বললেও আদালত শোনে না
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন দেয়া ডিসক্রিয়েশন অব দ্য কোর্ট। ডিসক্রিয়েশন মানেই পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। আমার সাবমিশন অপছন্দ। তিনি বলেন, রিমান্ডের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের কিছু নির্দেশনা (বাইরে আইনজীবীকে রেখে কাঁচে ঘেরা কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ) আছে। এটা কেবলমাত্র (আংশিক) ফলো করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বেলায়। অন্যদের ক্ষেত্রেও আইনজীবীরা আদালতে এগুলো বলে, কিন্তু শোনে না।’’
কেউ শোনেনি জাহালমের কথা
বিনাদোষে কারাভোগ করা বহুল আলোচিত একটি নাম জাহালম। আসামির সাথে চেহারার মিল থাকায় সালেকের পরিবর্তে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় এই পাটকল শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারিক আদালতে তিনি বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। কিন্তু কেউ শোনেনি তার কথা। ঘটনাটি আদালতের নজরে আনা চেম্বারের আইনজীবী সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয় এবং ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়।
‘কতদিনে নিষ্পত্তি করতেই হবে-সেই নিয়ম নাই’
বাগেরহাটের একটি আদালতে স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার দায়ে ২০০০ সালে মৃত্যুদণ্ড হয় শেখ জাহিদের। ২০০৪ সালে হাইকোর্টের রায়ের ১৬ বছর পর আপিল বিভাগে তিনি খালাস পান। তার আইনজীবী সরোয়ার আহমেদ বলেন, যদি আইন হতো, এতদিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতেই হবে, না করতে পারলে সেটার বেনিফিট আসামি পাবে। তাহলে এগুলো কমতো। নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ মামলার সংখ্যা অনেক। বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নেই।
‘বিচার না করে বৈষম্য করছে রাষ্ট্র’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, প্রতিটা আইনেই তদন্ত ও বিচার শেষ করার সময় বলা আছে। অনেকক্ষেত্রে হয়ত ১৮০দিনের তদন্ত বহু বছরেও শেষ হয় না। আবার বিচারক নেই, কোর্ট নেই-এ রকম নানা কিছুও হয়। কিন্তু অভিযুক্ত জেলে। অথচ সংবিধান বলছে, কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখা যাবে না। কোর্ট না থাকার জন্য আসামি কেন সাফার করবে? এটা অবশ্যই বৈষম্য। রাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে এই বৈষম্য করে যাচ্ছে। এর জন্য কোন ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না।
‘ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে আসামি’
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, জামিন বৈষম্যের সুযোগ নেই। কারণ জামিন শুরু হয় জেলা আদালতে। সেখানে উপযুক্ত হওয়ার পরও কেউ জামিন না পেলে তিনি উপরের কোর্টে আসতে পারেন। বিনা বিচারে কারাগারে থাকলে তাকে আদালতেই যেতে হবে, সেখানে বলতে হবে। আদালত সেটা তখন দেখবেন। কেউ বিনা বিচারে দীর্ঘ সময়ে কারাগারে থাকলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন।