জলবায়ুর বদল না চেনে ধনী-গরিব
৫ নভেম্বর ২০২১ওই এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর আর দাঁড়াতে পারেননি৷ পানীয় জলের অভাব৷ পুকুরে লবণ পানি ঢুকে গেছে৷ ফসলের ক্ষেতে লবণ পানি ঢুকে ক্ষেত বন্ধ্যা করে ফেলেছে৷ ফসল ফলেনা৷ যারা এলাকা ছাড়তে পেরেছেন তারা চলে গেছেন৷ যারা ধনী তারা শহরে গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকছেন৷ যারা গরিব তারাও কোনো না কোনো শহরে গিয়ে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন সপরিবারে৷ তারা কাজ হারিয়েছেন৷ জমি হরিয়েছেন৷ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন৷ তারা এখন জলবায়ু উদ্বাস্তু৷
দেশের দক্ষিণের জেলাগুলোতে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খুবই স্পষ্ট৷ বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাগুলোতে পানীয় জলের কষ্ট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে৷ গভীর নলকূপেও পানি পাওয়া যাচ্ছেনা৷ কিছু এনজিও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে৷ আবার সবাই মিলে দুই-একটি পুকুরের পানি রক্ষা করে তা পানের চেষ্টা করছেন৷ আর এই পানি সংকট নারীদের সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত করছে৷ কারন তারা পানির অভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পারছেন না৷ ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন৷ লবণ পানির কারণে এখন ওইসব এলাকার প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত৷
বছর বছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বেড়ে যাচ্ছে৷ অকাল বন্যা হচ্ছে৷ সাতক্ষীরার অনেক এলাকা এখন পানির নিচে৷ নদী, বিল আর পকুর একাকার হয়ে যাচ্ছে৷ ফসল নেই৷ বাড়ছে নদী ভাঙন৷ আর জলোচ্ছাস বেড়ে যাওয়ায় উপকুলের বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে৷ ফলে লবণ পানি ঢুকে যেমন চাষের জমি নষ্ট করছে৷ তেমনি মানুষের আশ্রয় হরিয়ে যাচ্ছে৷ যারা কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবন চালাতেন তারা আর কাজ পাচ্ছেন না৷ তারা ছুটছেন শহরে৷ কেই সপরিবারে৷ কেউ পরিবার রেখে একা৷
তারা যে শুধু ঢাকায় আসছেন তা নয়৷ তারা বিভাগীয় শহরেও যাচ্ছেন৷ যাচ্ছেন জেলা শহরে৷ যারা পারছেন না তারা বেড়িবাঁধে অস্থায়ী বসতি গড়ছেন৷ নগরের বস্তি এখন গ্রামেও৷ বেড়িবাঁধের উপরে৷
আমার গ্রামের বাড়ি দক্ষিণের একটি জেলায় নদী তীরবর্তী উপজেলায়৷ সেখানে প্রবিছরই বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়৷ গত শীতে গিয়ে দেখেছি খেসারির ডালের ক্ষেত হলুদ হয়ে গেছে৷ জানতে পারলাম লবণ পানি ঢুকে এই অবস্থা৷ ধানও আগের মতো আর হয় না৷ নদীর তীরে বানানো গুচ্ছগ্রামের ঘরও পানিতে ভেসে গেছে৷ আর পানির কষ্ট তো আছেই৷ তবে রেইন হারভেস্টিং কিছুটা হলেও পানীয় জলের কষ্ট কমিয়েছে৷
পেশাগত কাজেই দুই বছর আগে ঢাকার কয়েকটি বস্তিতে গিয়েছি৷ সেখানে এখন বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এলাকার লোক বেশি৷ আছে চাঁদপুর এলাকার লোকও৷ তাদের অধিকাংশই নদী ভাঙনের শিকার৷ আর কৃষি জমিতে কাজ হারিয়ে এসেছেন অনেকে৷ তাদের কথা লবণ পানি আর নদী ভাঙন সব শেষ করে দিচ্ছে৷
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ তাদের আবাস্থল হারাবেন৷
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বলেছেন, এরইমধ্যে বাংলাদেশের এককোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তে পরিণত হয়েছেন৷
বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে৷ এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মত৷ তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু৷
এই সপ্তাহেই কথা হয়েছে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার একজন পরিবেশ কর্মীর সঙ্গে৷ তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ধনী-গরিব দেখছেনা৷ স্বাস্থ্যের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছেনা৷ তার মতে প্রতিদিনই জলবায়ু উদ্বাস্তু হচ্ছে মানুষ৷ কাজ হারিয়ে কেউ খুলনা যাচ্ছেন৷ কেউ নারায়ণগঞ্জ, কেউ ঢাকা৷ সেখানে কাজ না পেলে রিকশা চালাচ্ছেন৷
সাতক্ষীরার একজন সাংবাদিক জানান, ওই এলাকায় বিভিন্ন উপজেলায় এখন খাবার পানির জন্য হাহাকার চলছে৷ নারীদের পায়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানীয় জল আনতে হয়৷
ওই এলকার গাবুরা পদ্মপুকুর, এল্লার চরের অনেক মানুষ যাদের পাকা ঘরবাড়ি ছিলো তারা এখন তা হারিয়ে খুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন৷ এখানে ধনী-গরিব সবাই এর শিকার৷
ঢাকার সদরঘাট এলাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের একটা আশ্রয় কেন্দ্র করা হয়েছে৷ সরকার সাধ্যমত গৃহহীন মানুষকে ঘর তৈরি করে দেয়ার চেষ্টা করছে৷ আছে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড৷ কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে?