জলবায়ু অর্থায়ন কি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের কাছে পৌঁছাচ্ছে?
১৫ নভেম্বর ২০২৪গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঝড় ড্যানিয়েল লিবিয়ার দেরনা বন্দর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়৷ এবং ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে দুটি বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি করে৷ এই বন্যা আশপাশের এলাকাগুলো ব্যাপক ক্ষতি করে এবং হাজারখানেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে৷ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ৫০ গুণ বেশি বেড়ে যায় এবং প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি তীব্র হতে পারে৷
লিবিয়ায় কয়েক দশকের সংঘাতের কারণে বিনিয়োগের ঘাটতিকে দায়ী করেছে জাতিসংঘ৷ পুরোনো অবকাঠামো অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত সামাল দিতে ব্যর্থ হয়৷ জাতিসংঘ জানিয়েছে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাঁধগুলো পুনর্নির্মাণ এবং প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য অর্থায়ন হলে অনেক মানুষের জীবন হয়তো বাঁচানো সম্ভব ছিল৷
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চরম আবহাওয়ায় এমন ঘটনা বাড়ার সাথে সাথে ব্যর্থ অবকাঠামো প্রতিস্থাপনের মতো জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্পে অর্থায়ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ তবে যেখানে এই অর্থ প্রয়োজন সেখানে তা পৌঁছানো সহজ নয়৷
‘‘যে পরিমাণ অর্থ আসছে তা খুবই কম [...] এবং যে অর্থ আসছে তা খুব ভালোভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না,'' বলেছেন জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) কোপেনহেগেন ক্লাইমেট সেন্টারের প্রভাব মূল্যায়ন ও অভিযোজন বিভাগের প্রধান হেনরি নেউফেল্ড৷
জলবায়ু অর্থায়ন কোথায় হয়েছে?
বিশ্বব্যাপী ২০২২ এবং ২০২৩ সালে প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার (১.৪ ট্রিলিয়ন ইউরো) জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ব্যয়ের দ্বিগুণ, এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকিতে বিনিয়োগ করা অর্থের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, বলে জানিয়েছে ক্লাইমেট পলিসি ইনিশিয়েটিভ, যারা জলবায়ু অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ করে৷
এই সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জলবায়ু-সম্পর্কিত অর্থের বেশিরভাগই বিনিয়োগকারী দেশেরঅভ্যন্তরীণ প্রকল্পে ব্যয় হয়৷ এর একটি বড় অংশ শিল্পোন্নত দেশ এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে ব্যয় হয়েছে৷
জলবায়ু অর্থায়ন সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত — প্রশমন (মিটিগেশন), যেমন নবায়নযোগ্য শক্তির অবকাঠামো নির্মাণ, যা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে আসতে সাহায্য করে৷ আর অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন), যা বন্যা প্রতিরোধের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়৷
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উভয় ক্ষেত্রেই বেশি সহায়তা প্রয়োজন৷ ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোটের অর্থায়ন বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মাইকাই রবার্টসন বলেছেন যে, এই অঞ্চলগুলো জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমন উভয়ের খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান চরম আবহাওয়া মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে৷
দরিদ্র দেশগুলো, যারা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে খুব কম অবদান রেখেছে, তারা তাপপ্রবাহ, ভারী বৃষ্টিপাত এবং খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ৷
২০০৯ সালে শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করবে৷ যার পরিমাণ বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার৷
এই অর্থায়নের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা, যেমন সমুদ্র প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, নবায়নযোগ্য শক্তি বাড়ানো বা ভারী বৃষ্টিপাতের বিরুদ্ধে অবকাঠামো মজবুত করা৷
যদিও ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অবশেষে পূরণ করা হয়েছে৷ এবং এবারের কপ২৯ সম্মেলনে এই বিষয়ে আবারো আলোচনা করা হচ্ছে৷
‘‘এই লক্ষ্য অর্জনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো, এই অর্থ সঠিক সময়ে এবং সহজ উপায়ে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাদের সত্যিই এটি প্রয়োজন,'' বলেছেন জো থোয়েটস, ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বিষয়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট৷
জলবায়ু অর্থায়নে প্রবেশাধিকার
এ পর্যন্ত জলবায়ু অর্থায়ন মূলত প্রকল্পভিত্তিক ছিল৷ দরিদ্র দেশগুলো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে৷ এছাড়া বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক বা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো নির্ধারিত সংস্থাগুলোর মাধ্যমেও আবেদন করা হয়ে থাকে৷
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো যেমন স্বল্পোন্নত দেশ এবং ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য অর্থায়নে প্রবেশাধিকার পাওয়া বিশেষভাবে কঠিন৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে, তুলনামূলকভাবে উচ্চ আয়ের দেশগুলোই মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন পায়৷
ডয়েচ ভেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মাইকাই রবার্টসন বলেন, ‘‘বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর প্রয়োজন বিবেচনায় রেখেই, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রক্রিয়া নির্মাণ এবং ডিজাইন করা হয়েছে, যা তাদের অর্থায়নে জন্য সবযোগিতা করবে৷''
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘টুভালুর জনসংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার এবং হয়তো একটিই সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা এই সেবা দিতে সক্ষম...এই ধরনের বাস্তব পরিস্থিতিতে দেখা যায় যে প্রক্রিয়াগুলো ছোট দেশগুলোর জন্য বা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তৈরি নয়৷''
এছাড়াও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি তহবিল সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পরিচালিত হয় এবং এর নিজস্ব নিয়মকানুন রয়েছে, যার ফলে আবেদন প্রক্রিয়া কয়েক বছর লেগে যেতে পারে৷ এর ফলে ছোট এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো, যাদের এমন দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য কম সম্পদ রয়েছে, তারা বাদ পড়ে যেতে পারে৷
‘‘এটি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ৷ আপনি বলতে পারেন না, ‘তোমার দোষ তুমি দরিদ্র, তাই আমরা তোমাকে অর্থ দিতে পারবো না৷ কারণ, তোমার সেই অর্থ চাওয়ার সক্ষমতা নেই','' বলেছেন সহায়তাকারী সংস্থা ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ড-এর জলবায়ু নীতি উপদেষ্টা সাবিনে মিনিঙ্গার৷
নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন
১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির অধীনে জলবায়ু অর্থায়নের বেশিরভাগই মিটিগেশন বা প্রশমনের জন্য বরাদ্দ৷ তবে, স্বল্পোন্নত দেশ এবং ছোট দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অভিযোজনের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ পেয়ে থাকে৷
২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে, তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় অর্ধেকই অভিযোজনের জন্য ছিল, যার একটি বড় অংশ ছিল অনুদান আকারে, যা ফেরত দিতে হবে না৷
২০২২ সালে অভিযোজনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ছিল আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রতিশ্রুতির ২৮ বিলিয়ন ডলার, এবং এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ তবে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ধারণামতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অভিযোজনের অর্থের বার্ষিক ঘাটতি রয়েছে ১৮৭ বিলিয়ন থেকে ৩৫৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে৷
যে অভিযোজন প্রকল্পগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে, সেগুলোর প্রায় অর্ধেককে অযৌক্তিক বা আরও অর্থায়ন না হলে স্থায়ীভাবে টেকসই হওয়া সম্ভব নয়৷
বেসরকারি অর্থায়ন ব্যবহার করা
বেশিরভাগ জলবায়ু অর্থায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করার জন্য ব্যয় হয়৷ তবে এই অর্থের অনেকটাই ঋণের আকারে আসে৷
‘‘এটি একটি বিশাল সমস্যা, যেটি আমরা সম্মুখীন হচ্ছি, যেখানে এটি ১০০ বিলিয়ন ডলারের হিসাবের মধ্যে ধরা হয়েছে, কিন্তু মূলত অর্থটি আবার সেই দেশগুলোর কাছে ফিরে যাচ্ছে যেগুলো এটি প্রদান করেছে — সুদসহ৷ তো, শেষমেষ, কে কাকে সহায়তা করছে?'' প্রশ্ন তুলেছেন রবার্টসন৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য ঋণসহ আর্থিক প্রক্রিয়ার একটি মিশ্রণ প্রয়োজন৷