জনসংখ্যা সমস্যাই বাড়াচ্ছে
৩০ জুলাই ২০১৮ডয়চে ভেলে: একটা মৌলিক প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যাক৷ একটা দেশের জনসংখ্যা এবং তার উৎপাদন ক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা – এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক থাকে?
ধ্রুবজ্যোতি নন্দী: হ্যাঁ, তা তো থাকেই৷ যে দেশের জনসংখ্যা যত বেশি, তার অভ্যন্তরীণ চাহিদাও তত বেশি৷ সেই অভ্যন্তরীণ চাহিদা থাকলে একটা বিপুল উৎপাদনের দরকার হয়৷ ভারতের মতো একটা দেশ, যার বিপুল জনসংখ্যা, সেই জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্যে যে ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তার ‘ইকোনমি অফ স্কেল' খুব সহজে আয়ত্ব করা যায়৷ একটা জিনিস ১,০০০ জনের জন্য তৈরি করতে যা খরচ, সেই একই জায়গায় এক লক্ষ লোকের জন্য জিনিসটা তৈরির খরচ তার থেকে কম৷ এটাই ইকোনমি অফ স্কেল৷ কাজেই জনসংখ্যার সঙ্গে উৎপাদনশীলতার একটা সম্পর্ক আছে৷ তার জন্যে একটা নিয়মিত লগ্নি আসতে থাকে৷ বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এই লগ্নি আসে৷ এই সুবিধেটা আছে৷
এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন আসে, যদি জনসংখ্যা বেশি হয়, কিন্তু তার দক্ষ, প্রশিক্ষিত কর্মীসংখ্যা কম হয়, তা হলে কি একই সুবিধে পাওয়া যায়? যদি কারিগরি শিক্ষা কম থাকে, দক্ষতা কম থাকে, পড়াশোনা কম থাকে – যে জিনিসগুলো বড় জনসংখ্যা হলে হয় যে-কোনো দেশে৷
যেটা হয় শেষ পর্যন্ত, শ্রম সুলভ হওয়ার ফলে কর্মীদের পাঞ্জা কষার ক্ষমতাটা কমে যায়৷ সস্তার শ্রমিক যদি সুলভ থাকে৷ চীনে যখন দ্রুত হারে উন্নয়নের কাজটা শুরু হয়েছিল, তখন চীনে যা মজুরি ছিল, আজকে বহু লোক চাকরি পেয়ে যাওয়ায় চীনে মজুরির হার অনেক বেড়েছে৷ ভারতেও সেটা বেড়েছিল৷ কিন্তু গত কয়েক বছরে উৎপাদনক্ষমতা যা আছে, চাহিদা তার সঙ্গে মানানসই নয় বলে বহু লোক কর্মপ্রার্থী হয়ে আছে৷ এবং এই কর্মপ্রার্থী হয়ে থাকার অসুবিধে যেটা, মাইনেটা কমে যায়, মজুরি কমে যায়৷ কাজেই দক্ষ কর্মীর অভাব আছে, সেটা বলব না৷ কিন্তু দক্ষ কর্মীদের যথাযোগ্য মজুরি আছে কিনা, সেইটা বরং সমস্যা৷
তা হলে কি এরকম একটা সহজ সিদ্ধান্তে আসা যায়, যে যে দেশের জনসংখ্যা বেশি, তাদের উন্নতির সম্ভাবনাও বেশি?
না, এতটা সরলীকরণ করব না৷ এটার দু'টো দিক আছে৷ সুবিধে এবং অসুবিধে৷ সুবিধেগুলো কী কী? একটা যেটা বললাম, যে বড় দেশ, বিরাট বড় বাজার, তার চাহিদা নিয়মিত বাড়ছে, ফলে নতুন নতুন লগ্নি আসছে৷ এই সুবিধেটা ভারতে কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে৷ পরে যেটা বললাম, সুলভ শ্রমশক্তি৷ এখানে কম টাকায় লোক পাওয়া যায়৷ এই কারখানাটাই যদি স্লোভাকিয়ায় করতে হয়, তা হলে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে৷ আর তৃতীয় সুবিধে যেটা, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ — একটা দেশের জনসংখ্যা অনেক হয়ে গেলে, সেটা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও চলে যায় এবং বিদেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা আসতে থাকে৷ বিদেশ থেকে ভারতে পাঠানো মোট বিদেশি মুদ্রার বাৎসরিক পরিমাণ এখন ০৪.৬ শতাংশ, যেটা একটা বিপুল অঙ্ক৷ মানে ২০১৮ সালে ৬৪,২০০ কোটি ডলার এই গ্লোবাল রেমিটেন্স মারফত পাওয়া যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
এর পাশাপাশি অনেকগুলো অসুবিধেও আছে৷ সেগুলোও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর৷ সবথেকে বড় অসুবিধে হচ্ছে, সম্পদের অসম বণ্টন৷ কলকাতার সল্টলেকের তথ্য প্রযুক্তি এলাকা সেক্টর ফাইভে ৩০ হাজার থেকে ৩ লক্ষ টাকা মাসে মাইনে পায়, এরকম লোক যেমন আছে, তেমনি রাস্তায় বেরিয়ে একটা মোড় ঘুরলে সার সার খাবারের দোকান, যেখানে ১৪/১৫/১৬/১৭ বছরের ছেলেরা, মেয়েরা খুব কম মাইনেতে কাজ করে৷ এই যে ঘোর বৈষম্য, এটা ক্রমশ প্রকট হতে থাকে৷ একটা দেশের মোট সম্পদের যে বাঞ্ছিত বণ্টন, সেটা না হওয়াটা একটা বড় রকমের সমস্যা হয়ে ওঠে৷
এর থেকেও বড় সমস্যা হচ্ছে খাবারের সমস্যা৷ ভারতের জনসংখ্যা বছরে বাড়ছে ১.২ শতাংশ হারে৷ আর খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ছে ০.৯ শতাংশ হারে৷ সোজা কথায়, আমাদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের থেকে কম৷ কাজেই একটা সময় দেশে খাদ্য সংকট অনিবার্য৷ যদি না আমরা আবার কোনো ম্যাজিক করে উৎপাদনটা বেশ কিছুটা বাড়িয়ে নিই৷ সুতরাং এটা একটা সমস্যা নয়, এটা একটা সংকট বলা যেতে পারে৷
আরও একটা সংকট হচ্ছে, দূষণ৷ যত মানুষ, তত দূষণ৷ যত মানুষ, তত বিদ্যুতের চাহিদা৷ ভারতের বিদ্যুৎ মানেই হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ৷ বিপুল দূষণ হচ্ছে শুধুমাত্র এত লোকের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গিয়ে৷ আর শুধু বায়ুদূষণই হচ্ছে, তা নয়৷ বায়ুদূষণ হচ্ছে, জলদূষণ হচ্ছে, মাটির তলার জলস্তর ক্রমশ নেমে যাচ্ছে৷ পানীয় জলের সংকট অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সেই জলসংকট৷ কিন্তু আমরা এখনও সেই নিয়ে ভাবছি না! প্রত্যেক বছর দিল্লি একটা ধোঁয়ায় ঢেকে থাকে৷ দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস৷ এবং সে ব্যাপারে কারো নাকি কিছু করার নেই৷ এরকমই নাকি থাকবে একটা দেশের রাজধানী!
কাজেই বড় জনসংখ্যার যেমন সুবিধে আছে, বড় জনসংখ্যার অসুবিধেগুলোও সাংঘাতিক বড়৷ বস্তুত সেই অসুবিধেগুলো সামলানোর রাস্তা আছে কিনা, সেটা গভীরভাবে ভাবার বিষয়৷ কারণ যতক্ষণ সেই রাস্তা খুঁজে না পাওয়া যায়, আমরা এক অনিবার্য সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছি৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷