ছাত্রলীগ কি দুর্বৃত্তদের সংগঠন?
৮ অক্টোবর ২০১৯হত্যা ছাড়াও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ ও নির্যাতনের অনেক অভিযোগ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে৷ শুধু সাধারণ পর্যায়ের কর্মী বা নেতার বিরুদ্ধে নয়, ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ আছে৷ টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দলটির সভাপতি শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে সম্প্রতি সংগঠন থেকে বিদায় করা হয়েছে৷ সর্বশেষ বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরারকে হত্যায় প্রমাণিত হয়েছে যে কত নৃশংস হতে পারে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী৷ হত্যাকান্ডে জড়িতরা বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদধারী নেতা৷
ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেয়া নিয়ে সমালোচনা করে নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আবরার৷ ধারণা করা হচ্ছে এ কারণে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নাম্বার কক্ষে নিয়ে তাকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ ওই কক্ষটি হলের শিক্ষার্থীদের কাছে টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত৷
সাবেক ছাত্র নেতা এবং ডাকসুর দুইবারের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘শুধু বুয়েট নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন ছাত্রলীগের টর্চার সেল আছে৷ আসলে এই ছাত্র সংগঠনটি এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে৷ তারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এদের ব্যবহার করছে৷ প্রতিবাদ ও ভিন্নমত দমনের জন্য এদের ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ফলে এই ছাত্র সংগঠনটির সন্ত্রাসই রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছে৷ আর সাধারণ ছাত্ররা তাদের হাতে মারা পড়ছে, নিগৃহীত হচ্ছে৷''
ছাত্রলীগের আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস৷ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই ছাত্র সংগঠনটি ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বীরোচিত ভূমিকা রাখে৷ স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাদের রয়েছে গর্ব করার মত ভূমিকা৷
ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর মনে করেন, ‘‘৯০-এর পর থেকেই প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের ছাত্র সংগঠনকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করেছে৷ শুধু ছাত্রলীগ নয়, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন ছাত্রদলও একই স্টাইলে হল দখল, টেন্ডার- চাঁদাবাজি করেছে৷ আওয়ামী লীগ যেহেতু টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় তাই তাদের ছাত্র সংগঠনেরও অপতৎপরতা বেশি৷''
তাঁর মতে, ‘‘এই পরিস্থিতির দায় এককভাবে ছাত্রলীগের নয়৷ নেতিবাচক জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন ঘটছে ছাত্রলীগের মধ্যে৷''
ছাত্রলীগ দুর্বৃত্ত এবং অপরাধীদের সংগঠনে পরিণত হচ্ছে কিনা- এর জবাবে ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এ কে এম আজিম মনে করেন, ‘‘ছাত্রলীগের সামনে এখন ছাত্রদের অধিকারভিত্তিক, গণমুখী কোনো কর্মসূচি নেই৷ ফলে তাদের কেউ কেউ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে৷ কিন্তু এটা সংগঠনের দায় নয়৷ ছাত্রলীগের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ছাড় দিচ্ছেনা৷ তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন৷ সর্বশেষ ঘটনায়ও আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলছে৷''
আর ছাত্রলীগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘‘ব্যক্তির অপরাধের দায় কখনো সংগঠন নেবে না৷ আমরা শুধু এটা বলেই শেষ করিনা, ব্যবস্থাও নিই৷ আগেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ আর বুয়েটের ঘটনায়ও আমরা তদন্ত কামিটি করে ২৪ ঘন্টার আগেই ১১ জনকে চিহ্নিত করে বহিস্কার করেছি৷ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে৷ ছাত্রলীগে কোনো সন্ত্রাসী, অপরাধীর জায়গা নেই৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ছাত্রলীগ অনেক বড় একটি সংগঠন৷ এখানে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজের মত অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে যেতে পারে৷ কিন্তু আমরা জানামাত্র ব্যবস্থা নেই৷ ব্যবস্থা না নিলে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারতেন৷ ছাত্রলীগে কখনোই দুর্বৃত্তদের জায়গা হবে না৷ আমারা ছাত্রলীগের মহান আদর্শ নিয়ে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই৷''
বুয়েট পরিস্থিতি
আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মীকে মঙ্গলবার ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়েছে৷ এর আগে হত্যার ঘটনায় সোমবার ১৯ জনকে আসামি করে মামলা হয়৷ বুয়েটের শিক্ষার্থীরা পূজার ছুটির মধ্যে আবরার হত্যার বিচারসহ সাত দফা দাবিতে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন৷ তারা শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবি করেছেন৷ অ্যাকাডেমিক ও ভর্তি কার্যক্রম অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণাও করেছেন আন্দোলনকারীরা৷
এই পরিস্থিতির মধ্যে বুয়েটের ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ছাত্রদের এড়িয়ে চলছেন৷ তিনি সংবাদ মাধ্যমের সাথেও কথা বলছেন না৷ তবে প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফর ইকবাল খান ডয়চে ভেলের কাছ দাবি করেন দায়িত্ব পালনে তিনি কোনো অবহেলা করেননি৷ আবরার হত্যাকাণ্ডকে দু:খজনক এবং মির্মম অভিহিত করে এর বিচার দাবী করেছেন তিনি৷ বলেন, ‘‘যারা এটা করেছে তার বর্বর, তারা মানুষ নামের যোগ্য নয়৷ এই ধরণের খুনীরা কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য হতে পারে না৷''