চোরাচালানির ক্ষতি
২৯ জানুয়ারি ২০১৪সুদূর জার্মানি থেকে কলকাতার চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়েছিল ওদের৷ সেটা ১৯৮৯ সাল, ওদের দু'জনের বয়স তখন মোটে পাঁচ৷ ওদের নামকরণ হয়েছিল বাবু এবং রানি৷ কলকাতা চিড়িয়াখানার দর্শকদের অতিপ্রিয় শিম্পাঞ্জি দম্পতি৷ ওদের নানা কাণ্ডকারখানা ২২ বছর ধরে মাতিয়ে রেখেছিল সবাইকে৷ দু'জনের মধ্যে রানি তাও একটু সভ্যভদ্র ছিল, হয়ত মহিলা বলেই! কিন্তু বাবুর নাচনকোঁদন ছিল দেখার মতো৷ দর্শকদের ছুঁড়ে দেওয়া রোদচশমা চোখে পরে হাসিমুখে বাবুকে ক্যামেরার সামনে ‘পোজ' দিতে দেখা গিয়েছে বহুবার৷ শহরে শীত এসেছে, খবরের কাগজের ফটোগ্রাফার বা টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা পার্সনরা চিড়িয়াখানার ছবি তুলে এনেছেন অথচ তার মধ্যে বাবুর ছবি নেই, এমন বোধহয় কখনও হয়নি৷
সেই আমোদপ্রিয় বাবুই গত তিন বছর ধরে ভয়ঙ্কর মনমরা৷ দর্শকদের সামনে আসতেই চায় না৷ নির্জনে মুখ গোঁজ করে বসে থাকে৷ কারণ বাবু এখন সাথিহারা৷ বছর তিনেক আগে ফুসফুসের সংক্রমণে মারা গিয়েছে রানি৷ সেই সময় বাবুকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল চিড়িয়াখানার কর্মীদের পক্ষে৷ প্রথমত ভয়ঙ্কর বদমেজাজি এবং মারমুখী হয়ে উঠেছিল বাবু৷ তেড়ে কামড়াতে যেত দর্শক, এমনকি তার নিয়মিত দেখভাল করত যারা, সেই কর্মীদেরও৷ তখন বাধ্য হয়েই খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছিল বাবুকে৷ তখন বাবু খালি খাঁচার গরাদে মাথা ঠুকত, চিৎকার করত, অথবা চুপচাপ বসে কাঁদত৷ শিম্পাঞ্জি যে নিজের মৃত সঙ্গীর শোকে এমন পাগল হতে পারে, না দেখলে বিঃশ্বাস করা সত্যিই শক্ত ছিল৷
সেই তখন থেকেই বাবুর একজন মানাসই সঙ্গীর খোঁজে উদ্যোগী হয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু কাজটা নেহাত সহজ ছিল না৷ কারণ, প্রথমত শিম্পাঞ্জিরা বন্দি দশাতেও জোড়েই থাকে৷ এক যদি না কোনো শিম্পাঞ্জির পুরুষ সঙ্গী মারা গিয়ে থাকে, হঠাৎ করে একটি জোড়বিহীন মেয়ে শিম্পাঞ্জি পাওয়াও শক্ত৷ তা ছাড়া বাবুর বয়স এখন প্রায় ২৭৷ শিম্পাঞ্জি বাঁচে ৩৫ থেকে ৪০ বছর৷ কাজেই বাবুর জন্যে যদি কমবয়সি একটা মেয়ে শিম্পাঞ্জি জোগাড়ও করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাবু মারা গেলে তারও একলা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা৷ তা ছাড়া দীর্ঘ ২২ বছর রানির সঙ্গে থাকতে অভ্যস্ত বাবু আদৌ সেই নতুন মেয়ে শিম্পাঞ্জিকে নিজের খাঁচায় মেনে নেবে কিনা, সংশয় ছিল সেই নিয়েও৷ তাই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এমনও ভাবছিলেন যে, দেশ বা বিদেশের অন্য কোনও চিড়িয়াখানা থেকে যদি এক জোড়া শিম্পাঞ্জি পাওয়া যায়, অন্য কোনো প্রাণীর বিনিময়ে৷ যেমন জিরাফ এখন বাড়তি হয়েছে কলকাতার চিড়িয়াখানায়৷ জার্মানির কোলন শহরের চিড়িয়াখানা থেকে ওই ১৯৮৯ সালেই যে একজোড়া জিরাফ আনা হয়েছিল, তাদের নাতি-পুতিরা এখন সংখ্যায় অনেক৷ কাজেই জিরাফ দিয়ে শিম্পাঞ্জি পাওয়া যায় কিনা, সেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন চিড়িয়াখানায়৷
এই অবস্থায় হঠাৎই প্রায় কোলে এসে পড়ল একেবারে তিন তিনটে শিম্পাঞ্জির বাচ্চা৷ একটি মেয়ে এবং দুটি ছেলে৷ দক্ষিণ ভারতের কোনো এক বিত্তবান লোকের বাড়ির ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার জন্য আফ্রিকা থেকে চোরাপথে পাচার করা হচ্ছিল তাদের৷ সঙ্গে পাঁচটি বিরল প্রজাতির মার্মোসেট বানর, পাঁচটি ম্যাকাও, ছটি কাকাতুয়া এবং চারটি ধূসর টিয়া৷ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বন দপ্তরের কর্মীরা কলকাতার পূর্ব শহরতলীর বাগুইআটি অঞ্চলের এক পাখি ব্যবসায়ীর বাড়িতে হানা দিয়ে প্রাণিগুলিকে উদ্ধার করেন৷ তদন্তে জানা গিয়েছে, মধ্য আফ্রিকা থেকে প্রথমে বিমানে হংকং, সেখান থেকে ফের বিমানে ঢাকা, তার পর বাংলাদেশ থেকে সড়কপথে বনগাঁ সীমান্ত পার হয়ে এগুলিকে কদিনের জন্য আনা হয়েছিল কলকাতায়৷ এখান থেকেই এরা পাড়ি দিত দক্ষিণ ভারত৷
কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রাণীগুলির কোনো যত্ন নেওয়া হয়নি৷ ফলে সবকটিই প্রায় অভুক্ত এবং অসুস্থ ছিল৷ শিম্পাঞ্জির বাচ্চা তিনটির মধ্যে মেয়েটির গায়ে জ্বর ছিল৷ অন্য দুটি খাঁচার মধ্যে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপছিল৷ উদ্ধার হওয়ার পরও অবশ্য শুল্ক দপ্তর আর বন দপ্তরের অধিকারগত কাজিয়া এবং সরকারি নিয়মনীতির ফাঁসে পড়ে প্রাণীগুলির নাভিশ্বাস উঠেছিল৷ তবে শেষপর্যন্ত ওদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে চিড়িয়াখানায় এবং চিকিৎসা, যত্নআত্তি শুরু হয়েছে৷ কলকাতা চিড়িয়াখানায় মার্মোসেট বানরের সফল প্রজনন হয়েছে, মার্মোসেটগুলি সেখানেই থাকতে পারে৷ পাখির জন্যেও সম্প্রতি নতুন, বড় খাঁচা তৈরি হয়েছে৷ আর শিম্পাঞ্জির জন্যে তো হাপিত্যেশ করে বসেই ছিল সবাই৷ কাজেই যদি আইনি সম্মতি এবং প্রশাসনিক ছাড়পত্র পাওয়া যায়, তা হলে কলকাতা চিড়িয়াখানাই হতে পারে ওদের স্থায়ী ঠিকানা৷