চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একগুচ্ছ নির্দেশ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪সিবিআইয়ের রিপোর্টে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য আছে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, রিপোর্টে কী আছে তা তিনি বলবেন না, তাতে তদন্তের গতি ব্যাহত হতে পারে। তবে তারা আগে যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই সব বিষয় রিপোর্টে আছে।
বিচারপতিরা আগে প্রশ্ন করেছিলেন, কারা এই ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত, আরজি করে আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে কিনা, আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে খুনের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, প্রমাণলোপের চেষ্টা হয়েছিল কিনা? কেন তড়াঘড়ি করে দেহ সৎকারের জন্য চাপ দিলো পুলিশ?
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানিয়েছেন, নিহত চিকিৎসকের বাবা সিবিআইয়ের কাছে চিঠি লিখে কিছু বিষয় তুলে ধরেছিলেন। সিবিআই সেই বিষয়টিগুলিও দেখছে। তিনি নির্দেশ দেন, সিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা যেন নিহত চিকিৎসকের বাবার কথাকে গুরুত্ব দেয়, তা তদন্ত করে দেখে এবং প্রয়োজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে।
তিনি জানান, তদন্তে যে সূত্র পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে, চিকিৎসকের বাবার উদ্বেগ সত্যি।
জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং এদিন আদালত ও সিবিআইয়ের কাছে একটি বন্ধ করা খামে কিছু নাম ও তথ্যপ্রমাণ তুলে দেন। তিনি বলেন, কয়েকজনকে খুনের জায়গায় দেখা গিয়েছিল, তাদের নাম ও তথ্যপ্রমাণ খামে আছে। গোপনীয় বলে সেই সব নাম তিনি প্রকাশ করছেন না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ''সিবিআইয়ের সত্য অনুসন্ধানে আরো কিছুটা সময় লাগবে।''
'রাত্রি সাথী' নিয়ে আপত্তি
জুনিয়র চিকিৎসকদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বলেন, রাজ্য সরকার 'রাত্রি সাথী' নামে একটা কর্মসূচি নিয়েছে। সেখানে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করার কথা। তাদের সাতদিন পুলিশ ট্রেনিং দেবে। তারপর দেড় হাজারেরও বেশি কর্মীকে রাতে নারী কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা হবে।
ইন্দিরা জয়সিং জানতে চান, ''কেন পুলিশ মোতায়েন করা হবে না? ভুলে যাবেন না, আরজি করে মূল অভিযুক্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার, একজন ঠিকাকর্মী। এদের হাতে কী করে রাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে?''
জবাবে কপিল সিবাল বলেন, ''এটা সাময়িক ব্যবস্থা। এক বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে।''
কিন্তু প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ''সিভিক ভলান্টিয়ারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি তো? নিরাপত্তার অভাবের জন্যই তো ওই সিভিক ভলান্টিয়ার সারা হাসপাতাল ঘুরেছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে অস্থায়ী কর্মী রাখবেন? ডাক্তাররা যেখানে ৩৬ ঘণ্টা কাজ করছেন, সেখানে এইভাবে কেন নিরাপত্তা দেয়া হবে?''
তিনি বলেন, ''চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিয়ে নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকার ভেবে দেখুক। পশ্চিমবঙ্গের সব সরকারি কলেজ ও হাসপাতালে এবং কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেয়া উচিত। মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কম বয়সি নারীরা কাজ করেন। ফলে সেখানে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নয়, পুলিশ রাখা উচিত।''
বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা
রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবাল দাবি করেন, ''রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই হাসপাতালগুলিতে বাড়তি সিসিটিভি, নারী চিকিৎসকদের জন্য আলাদা রেস্ট রুম ও টয়লেটের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।''
তিনি আরো বলেন, ''আরজি করে আরো ৪১৫টি ক্যামেরা লাগানো হবে।''
প্রধান বিচারপতির নির্দেশ, ‘‘প্রতিটি হাসপাতালে চিকিৎসকরা যেখানে থাকবেন, সেখানে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা চালু করুন। স্বাস্থ্যসচিবকে বলুন।'' কপিল সিবাল বলেন, তারা এই ব্যবস্থা চালু করবেন।
'বিজ্ঞপ্তি মোছার নির্দেশ'
রাজ্য সরকারের তরফে জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, মেয়েদের নাইট ডিউটি দেয়ার কাজ যতটা সম্ভব কম করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ''কী করে রাজ্য সরকার এরকম বিজ্ঞপ্তি জারি করলো? সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। তারা কী করে এই ধরনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে? নারীরা তো এই ধরনের কোনো ছাড় চান না। তারা সমান সুযোগ চান। নারী ডাক্তারদের সবধরনের পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়। রাজ্যকে নিরাপত্তা দিতেই হবে।''
কপিল সিবাল বলেন, বিজ্ঞপ্তির ওই অংশটি তারা মুছে দেবেন।
লাইভস্ট্রিমিং চলবে
রাজ্য সরকারের আইনজীবী সিবাল সুপ্রিম কোর্টের লাইভ স্ট্রিমিং নিয়েও আপত্তি জানান। তিনি লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ রাখতে বলেন।
কিন্তু প্রধান বিচারপতি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, এর সঙ্গে জনস্বার্থ জড়িয়ে আছে। তাই লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না।
প্রসঙ্গ : ডাক্তারদের কাজে ফেরা
জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার প্রশ্নওতোলেন সিবাল। তিনি বলেন, রোববার জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাদের প্রায় সব দাবি মেনেছেন। তারপরেও কেন তারা কাজে ফিরছেন না, কবে ফিরবেন?
জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বলেন, জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলির জেনারেল বডি মিটিংয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নেবেন। মঙ্গল বা বুধবার এই বৈঠক হবে।
ইন্দিরা জয়সিং আরো বলেন, ''জুনিয়র ডাক্তাররা মনে করছেন, যারা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পিছনে আছে, তারা এখনো আরজি করে আছে। তারা যোগ দিলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।'' তিনি বলেন, ''কোনো হাসপাতালে কিছু হলে তার জন্য রাজ্য প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও মেডিক্যাল কাউন্সিল দায়ী থাকবে।''
প্রধান বিচারপতি বলেন, ''কর্মবিরতির জন্য কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। নারীদের জন্য আলাদা ঘর, সিসিটিবি ক্যামেরা, বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা সবই চালু হয়ে যাচ্ছে।'' ইন্দিরা জয়সিংয়ের অনুরোধ মেনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উল্লেখও প্রধান বিচারপতি তার নির্দেশে করেছেন।
ইন্দিরা জয়সিংয়ের অনুরোধ মেনে তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের আস্থা ফেরানোর বিষয়টি নিয়েও প্রশাসনকে সক্রিয় হতে বলেছেন। জেলাশাসকদের বলেছেন, তাদের জেলায় হাসপাতালে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা যেন সিনিয়র ডাক্তার, জুনিয়র ডাক্তার, ও কর্মীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।
আগে নিরাপত্তা, তারপর কাজে যোগদান?
ডিডাব্লিউর সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষকে আইনজীবী অরিন্দম দাস বলেছেন, ''রাজ্য সরকার একটা কথা বারবার বলছিল, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু মঙ্গলবারের শুনানিতে বোঝা গেল, সুপ্রিম কোর্ট চাইছে, রাজ্য সরকার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। রাজ্য সরকার সেটা করতে পেরেছে কিনা, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।''
কতক্ষণের ভিডিও?
কলকাতা পুলিশ সিবিআইকে কতক্ষণের সিসিটিভি ফুটেজ দিয়েছে? রাজ্য সরকার বলছে, সাত-আট ঘণ্টার ফুটেজ দেয়া হয়েছে। সিবিআইয়ের দাবি মাত্র ২৭ মিনিটের ফুটেজ দেয়া হয়েছে।
এই দাবি, পাল্টা দাবি নিয়ে দুই তরফের আইনজীবীর মধ্যে তর্কাতর্কিও হয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ''যদি সিবিআই মনে করে পুরো সময়ের ফুটেজ দেয়া হয়নি, তাহলে তারা পুলিশের কাছ থেকে বাকি ফুটেজ চেয়ে নিক।''
সিনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী অভিযোগ করেন, ''রাজ্য সরকার মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। তারা সবকটি ঘটনা খতিয়ে দেখতে পারেননি। একটি দেখেছেন। সেখানে রাজ্য সরকার মিথ্যা দাবি করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।''
সন্তুষ্ট জুনিয়র ডাক্তাররা
সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে জুনিয়র ডাক্তাররা সন্তুষ্ট। তারা বলছেন, তাদের আইনজীবী ভালো করে তাদের কথা জানাতে পেরেছেন। তারা এবার জেনারেল বডির বৈঠক করে কাজে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
জিএইচ/এসিবি(সুপ্রিম কোর্টের লাইভ সম্প্রচার)