সমালোচনাকারীদের ‘নির্বোধ’ বললেন অর্থমন্ত্রী
৮ জুন ২০১৮সিপিডি বলেছে, ‘‘বাজেট বিকাশমনান মধ্যবিত্তকে করের চাপে ফেলবে৷ এই বাজেটে বৈষম্য দূর করার কোনো ব্যবস্থা নেই৷’’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) শুক্রবার সকালে ২০১৮-১৯ সালের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়৷ তাদের প্রতিক্রিয়া বলা হয়, ‘‘প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্ত এবং বিকাশমান মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা চাপানো হয়েছে৷ ভোগ, আয় ও সম্পদের বৈষম্য দূর করতে বাজেটে কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি৷ আগে এক হাজার ১০০ বর্গফুটের ছোট ফ্ল্যাটের দামের ওপর দেড় ভাগ হারে কর দিতে হতো৷ আর এক হাজার ৬০০ বর্গফুটের জন্য যা ছিল আড়াই শতাংশ৷ এখন দুটোকে গড়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে৷ এর ফলে মধ্যবিত্ত এবং বিকাশমান মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বাড়বে৷’’
ব্যক্তিখাতের করের সীমা ৩ লাখ টাকা করার সিপিডি'র প্রস্তাব আমলে না নেওয়ার সমালোচনা করে বলা হয়, এতে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমতো, কিন্তু তা করা হয়নি৷
সিপিডি'র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘নবীন বাংলাদেশের জন্য এটি একটি প্রবীণ বাজেট করা হয়েছে৷ ই-কমার্সের ক্ষেত্রে তরুণদের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে৷ তাঁদের ওপর করের বোঝা চাপানোতে বিকাশমান কর্মসংস্থানে ধাক্কা লাগতে পারে৷ এছাড়াও উবার, পাঠাওয়ের ক্ষেত্রে কর আরোপ করা হয়েছে, যা ভোক্তাদের ঘাড়ে পড়বে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘মধ্যমেয়াদি অবকাঠামোর জন্য বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ কমেছে৷ মানুষের দরিদ্র বিমোচনের হার কমেছে৷ দেশে ভোগ আয় এবং সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে৷ প্রবৃদ্ধির হার উঁচু বা নিচু হতে পারে৷ কিন্তু এর মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টিকেও প্রাধান্য দিতে হবে৷ আমরা দেখেছি ৫ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষের আয় ৬০ শতাংশের ওপর কমেছে৷ আবার উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে৷ এই অর্থনীতিতে শ্রম এবং উদ্যোগের তুলনায় পুঁজি বিনিয়োগে আয়ের সুযোগ অনেক বেশি৷ এতে উন্নয়নের সুবিধা গরিব মানুষ পাচ্ছে না৷’’
সিপিডি'র বাজেট পর্যালোচনায় বলা হয়ে, ‘‘অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার ৬০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে৷ ঋণের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হবে৷ সঞ্চয়পত্রের ঋণের জন্যও সরকারকে ১৩ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হবে৷ ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করতে গেলেও তারল্য সংকট দেখা দেবে৷’’
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ১৫ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য ৪৫ হাজার কোটি টাকা আর বাকি ৫৫ শতাংশ অন্য ২২ মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের জন্য৷ এই পরিমাণ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি৷ বলা হয়েছে, বাজেটে ২২ হাজার কোটি টাকা পুঁজি হিসেবে রাখা হয়েছে, কিন্তু এই পুঁজি কোথায় বিনিয়োগ করা হবে তা পরিষ্কার করা হয়নি৷ সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করা হবে৷
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে৷ এজন্য ১১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ করতে হবে, যা গত বছরের তুলনায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি৷ এই অর্থ বিনিয়োগকে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে৷ মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়েছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত এই হার ঠিক রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছে সিপিডি৷
সিপিডি বলছে, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় এই বছর পদ্মা সেতু প্রকল্প শেষ হবে জানালেও আদৌ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে৷ তারা বলছে, প্রকল্পটিতে ৩ শতাংশ হারে সময় বেড়েছে৷ আর ব্যয় বেড়েছে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ হারে৷ ব্যয় আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে৷ এডিপি বাস্তবায়নে কোনো নতুন পদক্ষেপ নেই৷
সিপিডি ব্যাংক খাতের কর্পোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমানোর সমালোচনা করে বলেছে, ব্যাংকের লুটপাট ঠিক না করে কর কমানো উচিত হয়নি৷ এতে মালিকপক্ষ এককভাবে লাভবান হবে৷ ঋণগ্রহীতা এবং আমানতকারী কোনও সুবিধা পাবে না৷
এদিকে দুপুরের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমার প্রতিটি বাজেটই নির্বাচনি বাজেট৷ আমি একটি দলের সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য৷ সে হিসেবে আমার বাজেট নির্বাচনি বাজেটই হবে৷ আমি এমন বাজেট দিই যেটা মানুষ পছন্দ করবে৷’’
সাংবাকিদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘যারা নির্বোধ ও যাদের দেশপ্রেম নেই, তারাই বলে ভুয়া বাজেট৷ ভুয়া বাজেট বলে কিছু নেই৷ বাজেট যখন দেই, সেটা ভেবেই দেই৷ এ বছর লক্ষ্যমাত্রা যা নির্ধারণ করেছি তা বাস্তবায়নরযাগ্য বলে মনে করি৷’’
মুহিত বলেন, ‘‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্তমান সরকারের সময়ের মতো সুযোগ-সুবিধা আগে কখনও পাননি, যারা ৪০ হাজার টাকা বেতন পেতেন তারা এখন পাচ্ছেন ৭৮ থেকে ৮০ হাজার টাকা৷ তাছাড়া পেনশনের অবস্থা ভালো ও ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আমার মনে হয় না, সরকারি কর্মকর্তাদের এমন কেউ আছেন, যারা আরও সুযোগ-সুবিধা চান৷’’
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘‘ভার্চুয়াল বিজনেস, যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলের ওপর ট্যাক্স ধার্য করার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছি৷ কিন্তু অনলাইন বিজনেসকে আমরা আলাদা রেখেছি৷ এটার ওপর আমরা ভ্যাট রাখিনি৷ অনলাইনে (ই-কমার্স) কেনাকাটায় ক্রেতাকে কোনও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হবে না৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এবারের বাজেট সম্পর্কে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাজেটে যাঁরা নতুনত্ব আশা করেছিলেন, তাঁরা হতাশ হয়েছেন৷ কারণ, আগের বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন কিছু নেই৷ আমাদের অর্থনীতিতে নতুন যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবেলার বাজেটে না আছে কোনো কৌশল, না আছে কোনো পরিকল্পনা, না আছে কোনো প্রনোদনা৷ বর্তমানে কর্মসংস্থানহীন যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, দারিদ্র্য পরস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, বৈষম্য কমছে না৷ অন্যদিকে মানুষের মধ্যে হাতাশা বাড়ছে৷ রাজনৈতিক অধিকারহীনতা চলছে৷ এসব সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার কোনো নির্দেশনা এই বাজেটে নেই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের যেসব খাত নিয়ে এখন নৈরাজ্য চলছে, যেমন ব্যাংকিং খাত, অবকাঠামো খাতে অধিক ব্যয়, শিক্ষাখাতে মানহীনতা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এসব বিষয় নিয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু নেই৷ নেই উত্তরণের পথ৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকার বাজেটে একটি অপ্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে কর কাঠামো ঢেলে সাজিয়েছে৷ আর তা হলো মূল্য সংযোজন কর৷ এর প্রভাব সকল মানুষের জন্য সমান৷ এর ফলে গরীব, নিম্নবিত্ত এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে৷ এটা মোটেই প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা নয়৷ প্রগতিশীল কর ব্যবস্থায় আয়কর রাজস্ব আয়ের শীর্ষে থাকে৷ কিন্তু আমাদের উল্টো৷ এখানে শীর্ষে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)৷ কর্মসংস্থান না বাড়ায় অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর অনেকে নির্ভরশীল৷ ফলে তাদের ওপর এই ভ্যাটের চাপ সবচেয়ে বেশি পড়বে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ডলারের দাম বাড়ছে, আমদানি বাড়ছে৷ ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে৷ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না৷’’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনীতি এবং এই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া৷ আর সেখানে যেতে হলে আমাদের অর্থনীতির বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি আছে, যার জন্য বড় ধরনের কিছু সংস্কার দরকার ছিল৷ মানসম্মত কর্মস্থান এবং শিক্ষা বিস্তারের জন্য আমাদের বেশ কিছু সংস্কার দরকা ছিল৷ বাজেটের বাস্তবায়ন একটা বড় বিষয়, যা অর্থমন্ত্রী নিজেও শিকার করেছেন৷ আমাদের প্রকল্পগুলোতে অহেতুক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে৷ বেশি খরচ করা হচ্ছে৷ অনেক প্রকল্প সুচিন্তিতভাবে নেয়া হয়নি৷ এই ঝুঁকিগুলো মোকবেলার জন্য যেসব সংস্কার দরকার ছিল, বাজেটে তা করা হয়নি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এটা গতানুগতিক বাজেট৷ এখানে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ নির্বাচনকে মাথায় রেখে দলের এমপিদের জন্য প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার দু'টি প্রকল্প রেখেছেন, যা পুরো বাজেটের চার শতাংশ৷ এই প্রকল্পের আওতায় মাদ্রাসা ও স্কুলের বিল্ডিংগুলো উন্নত করা হবে, কিন্তু এমপির তত্ত্বাবধানে৷’’
তাঁর মতে, ‘‘ব্যাংকিং খাতে সংস্কার প্রয়োজন ছিল, বিশেষ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে ব্যক্তিখাতে বিানয়োগকে উৎসাহ দিতে হবে৷ আর সেটা করতে হলে বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো করতে হবে৷ কর্পোরেট ট্যাক্স যেটা কমানো হয়েছে, তাতে ব্যাংক মালিকরা লাভবান হবেন৷ সার্বিকভাবে বিনিয়োগ বা ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে কোনো কাজে লাগবে না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে দেখছি বাজেটে সাহিত্য ভালো হচ্ছে, কিন্তু অর্থনীতি তেমন হচ্ছে না৷ অর্থনীতির সংকট ও ঝুঁকি নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু তা থেকে বের হওয়ার উপায় বাজেটে থাকছে না৷ এটা তাই জনতুষ্টির বাজেট, কিন্তু অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বাজেট নয়৷’’