ঘেরাও থেকে ধস্তাধস্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার কী হবে?
২৬ নভেম্বর ২০২২বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যত্নে লালিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বীরভূমের বোলপুরের শান্তিনিকেতনে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামডাক রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও।সেখানে কর্তৃপক্ষ ও পড়ুয়াদের মধ্যে বিরোধ নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন দাবিতে চলতি সপ্তাহে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে ঘেরাও করেন বিশ্বভারতীর পড়ুয়ারা। ১২ ঘণ্টা ধরে চলে ঘেরাও বিক্ষোভ। ছাত্রছাত্রীদের এই কর্মসূচি চলাকালীন মারাত্মক অভিযোগ ওঠে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। পড়ুয়াদের দাবি, উপাচার্য তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে বলেছেন। এই অভিযোগ খারিজ করে উপাচার্যের পাল্টা দাবি, পড়ুয়ারা তার গায়ে হাত তুলেছে।
বিশ্বভারতীতে আন্দোলনকারী ছাত্র প্রত্যূষ মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "”উপাচার্য ক্যাম্পাসে স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছেন। পড়ুয়া থেকে অধ্যাপকদের সাসপেন্ড করছেন। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এক ছাত্রকে ভর্তি নিতে চাইছেন না।"”
এই বিক্ষোভ ঘিরে বুধবার দফায় দফায় অশান্ত হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপাচার্যকে ঘিরে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। উপাচার্যের ঘরের দরজা ভেঙে পড়ুয়ারা ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতাহাতি লেগে যায়। দুই পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এক পড়ুয়া ও এক নিরাপত্তারক্ষী আহত হয়েছেন।
বিশ্বভারতীর ছাত্র সোমনাথ সৌ তিন দফায় নয় মাস সাসপেন্ড ছিলেন। পরে তাকে বহিষ্কারও করা হয়। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "”আমাকে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। হাইকোর্টে মামলা করে ভর্তির পক্ষে রায় এনেছি। তবু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিচ্ছে না।"” শুক্রবার থেকে উপাচার্যের বাড়ির সামনে অবস্থান বিক্ষোভে বসেছেন পড়ুয়ারা। শনিবারও চলছে অবস্থান।
দক্ষিণের বোলপুরে যখন এই ছবি, তখন ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। অভিযোগ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাও মঞ্চ। শুক্রবার এই মঞ্চের বিক্ষোভ মিছিল পুলিশ রোখার চেষ্টা করলে ধুন্ধুমার বাধে।
আন্দোলনকারীদের দাবি, হোটেল তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনার জন্য অধ্যাপক ও পড়ুয়াদের উপাচার্য ওমপ্রকাশ মিশ্রর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। যদিও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, জমির মালিকানা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে থাকছে। ওই জমিতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
মিশ্র বেশিদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসেননি। আগের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য এখন জেলে। স্কুল নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
কিছুদিন আগেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংকটের বিষয়টি সামনে এসেছিল। এ জন্য কর্তৃপক্ষ প্রাক্তনীদের কাছে সাহায্য চান। রাজ্য দাবি করে, তাদের প্রদেয় অর্থ যাদবপুরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রের প্রদেয় টাকা না মেলায় সমস্যা হচ্ছে।
কলকাতায় অবস্থিত আর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী সম্প্রতি পদত্যাগের ইচ্ছেপ্রকাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কার্যালয়ে কর্মীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় কাজ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণেই তিনি পদ ছাড়তে চান বলে সংবাদে প্রকাশ।
রাজ্য সরকার ও রাজ্যপালের দ্বন্দ্বের ফলও ভুগতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। দেশের অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়কে আচার্য তথা রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়াই নিয়োগ করে রাজ্য। তার নিয়োগ হাইকোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টও বাতিল করে দেয়। ফলে এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো স্থায়ী উপাচার্য নেই।
স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে এই সপ্তাহেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের বাইরে গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন শাসক ও বিরোধী শিবিরের ছাত্র সংগঠনের সমর্থকরা। পুলিশ ব্যারিকেড করে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
এই প্রতিষ্ঠানগুলি স্বশাসিত, এর মধ্যে বিশ্বভারতীয় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালনার ভার যাদের হাতেই থাকুক, পশ্চিমবঙ্গের একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘিরে এ সব ঘটনা চিন্তায় রেখেছে পড়ুয়া, অভিভাবক থেকে শিক্ষা মহলকে। এতে যে আখেরে পড়াশোনারই ক্ষতি!
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের রাজ্যের উচ্চশিক্ষা, মধ্যশিক্ষা, নিম্নশিক্ষা সবই সংকটের মধ্যে রয়েছে। স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য জেলে রয়েছেন। সবমিলিয়ে ভয়ঙ্কর লজ্জার পরিস্থিতি।"
সাবেক অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার দুর্নীতির সঙ্গে শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ নিয়ে চিন্তিত। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "”বুনিয়াদি থেকে উচ্চশিক্ষা পণ্য হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে চাকরিও টাকা দিয়ে কেনা হচ্ছে। শিক্ষা ক্রয়যোগ্য হয়ে উঠলে যা হয়, সেটাই দেখতে পাচ্ছি।"”