এর কয়েক দিনের মধ্যেই আবার আট বছরের এক শিশুর ৯৯৯-এ ফোন করে মায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ জানানোর খবর ঘোরাফেরা করতে লাগলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ দ্বিতীয় ঘটনাটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ অন্যরকম হলেও উন্নত দেশগুলোতে এ ঘটনা বেশ স্বাভাবিক৷ বেশ অনেকদিন আগে প্রবাসী এক বন্ধুর এমন এক অভিজ্ঞতা শুনে খুব হেসেছিলাম৷ অসহায় বন্ধুটির রাগ আরো বাড়াতে নানা কথাও বলেছিলাম৷ নিজের বাচ্চাকে শাসনের নামে মারধর এতটাই প্রচলিত আমাদের দেশে যে এ নিয়ে কাউকে পুলিশের নজরে পড়তে হবে, ব্যাপারটা ভাবনার বাইরে আমাদের৷ তবে সে ঘটনা এখন দেশেও ঘটছে জেনে এর মধ্যেই অনেককে আতংকিত হতে দেখেছি৷ কিন্তু মোটের উপর শিশুদের শাসন আর তাদের উপর নির্যাতনের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আমাদের ভাবনার জায়গাটা কেমন যেন ভাসা ভাসা৷ শিশু অধিকার নিশ্চিতের প্রশ্নে নিম্নবিত্তের সাথে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে মোটাদাগের পার্থক্য থাকলেও ‘পারিবারিক অশান্তি'র পয়েন্টে এসে সবপক্ষই মিলে যাই আমরা৷
শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে যে প্রাণান্ত চেষ্টা, তার বিপরীতে শিশুটির উপর অধিকারবোধ চর্চার সংস্কৃতি আমাদের মজ্জাগত৷ হতদরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পরিবার সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতেই হিমশিম খায় আর তাই নিজের বা শিশুর কারো অধিকার নিয়েই খুব বেশি সোচ্চার হওয়ার সুযোগ কম৷ তবে মধ্যবিত্তের সংকট ভিন্ন৷
আমাদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যতটা না পরিকল্পনা, তার চেয়ে বেশি ঘটনার পরিক্রমা৷ এরমধ্যে প্রথম কয়েক বছরতো শিশুকে নিয়ে আমাদের পুতুল-পুতুল খেলা৷ টুকটুক করে কথা বলতে শেখা শিশুটির আধো আধো নানা কথা মন কেড়ে নেয়৷ তবে ধীরে ধীরে পরিণত মানুষের মতো মতপ্রকাশেই গিয়ে বাধে বিপত্তি৷ ফুলের মত, পাখির মত শিশুটির যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ বোধ তীব্র হচ্ছে, এই কথাটাই আমরা মা-বাবারা বেমালুম ভুলে যাই৷ অতঃপর অবধারিত সংঘাত৷ শিশুটির অস্ত্র- কান্নাকাটি, অবাধ্যতা আর বড়দের অস্ত্র- বকাঝকা-মারধর৷
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে মারধরের মতো শাসনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে৷ স্কুলগুলোতে শিশুদের আঘাত না করার নির্দেশনা জারি আছে৷ তবে মজ্জাগত ভাবনা তো অত সহজে যাওয়ার নয়৷ সন্তানদের আমরা এতটাই নিজেদের মনে করি যে তাদের আর আলাদা ভাবা হয় না আমাদের৷ সেটা যে শিশুমনে বিরূপ প্রভাব ফেলে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের বারংবার সতর্কতাতেও আমাদের যেন বিশ্বাস হতে চায় না!
আমাদের শিশুদের জন্য আছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ কঠিন শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নামে আছে দেখনদারি ও প্রতিযোগিতার চাপ৷ এর বিপরীতে খেলার সময়-সুযোগ বড় ক্ষীণ৷ চার দেয়াল ও চৌকো বাক্সের উপর ভর করেই আমাদের ফুলগুলো বেড়ে উঠে৷ আমরা যারা বাবা-মা, তাদের সময়ও বড় কম৷ ‘কোয়ালিটি টাইম' কথাটা ইদানিং ‘মোটিভেশনাল’ নানা বক্তব্যে ঘুরে ফিরে আসে৷ আমরাও নানা ফর্মুলার এপাশ ওপাশ কাটছাট করে শিশুদের বড় করতে থাকি৷ তবে এসবের মধ্যেও সন্তানকে আলাদা মানুষ ভাবার অবকাশ আমাদের হয়না বললেই চলে৷ অবশ্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নে সববয়সী মানুষেরই হরে দরে এক অবস্থা বঙ্গদেশে৷ তবুও শিশু প্রশ্নে সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই কোন৷ যেমনটা অভিজ্ঞরা বলে থাকেন, ব্লটিং পেপারের মতো সব শুষে নেয় শিশু৷ শিশু প্রশ্নে তাই প্রয়োজন অভিভাবকের সতর্ক অবস্থান৷
এখানটাতেই ফিরতে হবে শুরুর প্রসঙ্গে৷ কেবল পথশিশু নয়, আমাদের আশেপাশের অনেকশিশুই নানা নেতিবাচক প্রভাবের ভেতর দিয়ে দিন কাটায়৷ সেখানে তার চাওয়ার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন আছে, আশেপাশের সবার চাওয়া তার উপর চাপিয়ে দেয়া আছে, এমনকি মায়ের প্রতি পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক, বা আরো এগিয়ে সহিংসতাও আছে৷ অনেকেই তাই পরিবারে বা সবচেয়ে আপন বাবা-মায়ের কাছেই অবমূল্যায়িত হয় মারাত্মক ভাবে৷ পরিবারে শিশু অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজন সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা, প্রয়োজন বাবা-মায়ের মানসিক স্থিতি৷ উন্নত দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ৯৯৯ এ ফোন করাকে উদাহরণ না টেনে শিশুর জন্য ঘর কি করে নিরাপদ করা যায়, তা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন৷ মায়ের বিরুদ্ধে শিশুর পুলিশে অভিযোগের বিপরীতে মাকে এককভাবে দোষী করে শিশুকে দাদা বা নানার বাড়িতে রেখে আসা একেবারে শেষ সমাধান৷ বরং দীর্ঘদিন এ পরিস্থিতি চললে মায়ের পাশাপাশি বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দায় এতে কম নয়৷
আমরা প্রায়ই কথা বলি শিক্ষাব্যবস্থার চাপ নিয়ে৷ বলি খেলার মাঠ না থাকার কথা৷ যথার্থই এসব বিষয়ে আরো অনেক বেশি কথা হওয়া প্রয়োজন৷ তবে ঘরের পরিবেশও যেন নজর না এড়ায়৷ সাধ্যের মধ্যে নিজেদের ঘরটাই আমরা সবার আগে শিশুবান্ধব করতে পারি৷ নতুন নতুন ফমুর্লার চেয়ে বাবা-মায়ের স্বতঃস্ফুর্ত আহ্লাদের প্রসাদগুণ বরাবরই বেশি৷ তবে তা যেন শিশুর ব্যক্তিত্বকে খর্ব করে না হয়৷
বাবা-মা হিসেবে আমাদের ওপর সমাজের যে চাপ, তা অতিক্রম করে শিশুকে বোঝার মতো মন তৈরিতে অভিভাবকের সতর্ক চেষ্টা প্রয়োজন৷
কাহলিল জিবরান যেমনটা বলেছেন
‘‘তোমরা ওদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে পারো,
কিন্তু তোমরা যেমন-ওদের তেমন করে তুলতে চেয়ো না৷
কারণ জীবন কখনো পেছনে ফিরে যায় না৷’’