1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘর হোক শিশুবান্ধব

রেশমী নন্দী
২৮ এপ্রিল ২০২৩

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপে উঠে এসেছে, পথশিশুদের ৬৪ শতাংশই পরিবারে ফিরতে চায় না৷ অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি কারণ ‘পারিবারিক অশান্তি’৷

https://p.dw.com/p/4Qf7o
সিলেটে একটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েকজন শিশু৷
ঘরকে সবার আগে শিশুবান্ধব করা প্রয়োজন৷ছবি: Md Rafayat Haque Khan/ZUMA Press Wire/picture alliance

এর কয়েক দিনের মধ্যেই আবার আট বছরের এক শিশুর ৯৯৯-এ ফোন করে মায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ জানানোর খবর ঘোরাফেরা করতে লাগলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ দ্বিতীয় ঘটনাটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ অন্যরকম হলেও উন্নত দেশগুলোতে এ ঘটনা বেশ স্বাভাবিক৷ বেশ অনেকদিন আগে প্রবাসী এক বন্ধুর এমন এক অভিজ্ঞতা শুনে খুব হেসেছিলাম৷ অসহায় বন্ধুটির রাগ আরো বাড়াতে নানা কথাও বলেছিলাম৷ নিজের বাচ্চাকে শাসনের নামে মারধর এতটাই প্রচলিত আমাদের দেশে যে এ নিয়ে কাউকে পুলিশের নজরে পড়তে হবে, ব্যাপারটা ভাবনার বাইরে আমাদের৷ তবে সে ঘটনা এখন দেশেও ঘটছে জেনে এর মধ্যেই অনেককে আতংকিত হতে দেখেছি৷ কিন্তু মোটের উপর শিশুদের শাসন আর তাদের উপর নির্যাতনের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আমাদের ভাবনার জায়গাটা কেমন যেন ভাসা ভাসা৷ শিশু অধিকার নিশ্চিতের প্রশ্নে নিম্নবিত্তের সাথে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে মোটাদাগের পার্থক্য থাকলেও ‘পারিবারিক অশান্তি'র পয়েন্টে এসে সবপক্ষই মিলে যাই আমরা৷

শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে যে প্রাণান্ত চেষ্টা, তার বিপরীতে শিশুটির উপর অধিকারবোধ চর্চার সংস্কৃতি আমাদের মজ্জাগত৷ হতদরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পরিবার সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতেই হিমশিম খায় আর তাই নিজের বা শিশুর কারো অধিকার নিয়েই খুব বেশি সোচ্চার হওয়ার সুযোগ কম৷ তবে মধ্যবিত্তের সংকট ভিন্ন৷

আমাদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যতটা না পরিকল্পনা, তার চেয়ে বেশি ঘটনার পরিক্রমা৷ এরমধ্যে প্রথম কয়েক বছরতো শিশুকে নিয়ে আমাদের পুতুল-পুতুল খেলা৷ টুকটুক করে কথা বলতে শেখা শিশুটির আধো আধো নানা কথা মন কেড়ে নেয়৷ তবে ধীরে ধীরে পরিণত মানুষের মতো মতপ্রকাশেই গিয়ে বাধে বিপত্তি৷ ফুলের মত, পাখির মত শিশুটির যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ বোধ তীব্র হচ্ছে, এই কথাটাই আমরা মা-বাবারা বেমালুম ভুলে যাই৷ অতঃপর অবধারিত সংঘাত৷ শিশুটির অস্ত্র- কান্নাকাটি, অবাধ্যতা আর বড়দের অস্ত্র- বকাঝকা-মারধর৷

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে মারধরের মতো শাসনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে৷ স্কুলগুলোতে শিশুদের আঘাত না করার নির্দেশনা জারি আছে৷ তবে মজ্জাগত ভাবনা তো অত সহজে যাওয়ার নয়৷ সন্তানদের আমরা এতটাই নিজেদের মনে করি যে তাদের আর আলাদা ভাবা হয় না আমাদের৷ সেটা যে শিশুমনে বিরূপ প্রভাব ফেলে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের বারংবার সতর্কতাতেও আমাদের যেন বিশ্বাস হতে চায় না!

আমাদের শিশুদের জন্য আছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ কঠিন শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নামে আছে দেখনদারি ও প্রতিযোগিতার চাপ৷ এর বিপরীতে খেলার সময়-সুযোগ বড় ক্ষীণ৷ চার দেয়াল ও চৌকো বাক্সের উপর ভর করেই আমাদের ফুলগুলো বেড়ে উঠে৷ আমরা যারা বাবা-মা, তাদের সময়ও বড় কম৷ ‘কোয়ালিটি টাইম' কথাটা ইদানিং ‘মোটিভেশনাল’ নানা বক্তব্যে ঘুরে ফিরে আসে৷ আমরাও নানা ফর্মুলার এপাশ ওপাশ কাটছাট করে শিশুদের বড় করতে থাকি৷ তবে এসবের মধ্যেও সন্তানকে আলাদা মানুষ ভাবার অবকাশ আমাদের হয়না বললেই চলে৷ অবশ্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নে সববয়সী মানুষেরই হরে দরে এক অবস্থা বঙ্গদেশে৷ তবুও শিশু প্রশ্নে সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই কোন৷ যেমনটা অভিজ্ঞরা বলে থাকেন, ব্লটিং পেপারের মতো সব শুষে নেয় শিশু৷ শিশু প্রশ্নে তাই প্রয়োজন অভিভাবকের সতর্ক অবস্থান৷

রেশমী নন্দী, সাংবাদিক
রেশমী নন্দী, সাংবাদিকছবি: privat

এখানটাতেই ফিরতে হবে শুরুর প্রসঙ্গে৷ কেবল পথশিশু নয়, আমাদের আশেপাশের অনেকশিশুই নানা নেতিবাচক প্রভাবের ভেতর দিয়ে দিন কাটায়৷ সেখানে তার চাওয়ার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন আছে, আশেপাশের সবার চাওয়া তার উপর চাপিয়ে দেয়া আছে, এমনকি মায়ের প্রতি পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক, বা আরো এগিয়ে সহিংসতাও আছে৷ অনেকেই তাই পরিবারে বা সবচেয়ে আপন বাবা-মায়ের কাছেই অবমূল্যায়িত হয় মারাত্মক ভাবে৷ পরিবারে শিশু অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজন সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা, প্রয়োজন বাবা-মায়ের মানসিক স্থিতি৷ উন্নত দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ৯৯৯ এ ফোন করাকে উদাহরণ না টেনে শিশুর জন্য ঘর কি করে নিরাপদ করা যায়, তা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন৷ মায়ের বিরুদ্ধে শিশুর পুলিশে অভিযোগের বিপরীতে মাকে এককভাবে দোষী করে শিশুকে দাদা বা নানার বাড়িতে রেখে আসা একেবারে শেষ সমাধান৷ বরং দীর্ঘদিন এ পরিস্থিতি চললে মায়ের পাশাপাশি বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দায় এতে কম নয়৷

আমরা প্রায়ই কথা বলি শিক্ষাব্যবস্থার চাপ নিয়ে৷ বলি খেলার মাঠ না থাকার কথা৷ যথার্থই এসব বিষয়ে আরো অনেক বেশি কথা হওয়া প্রয়োজন৷ তবে ঘরের পরিবেশও যেন নজর না এড়ায়৷ সাধ্যের মধ্যে নিজেদের ঘরটাই আমরা সবার আগে শিশুবান্ধব করতে পারি৷ নতুন নতুন ফমুর্লার চেয়ে বাবা-মায়ের স্বতঃস্ফুর্ত আহ্লাদের প্রসাদগুণ বরাবরই বেশি৷ তবে তা যেন শিশুর ব্যক্তিত্বকে খর্ব করে না হয়৷

বাবা-মা হিসেবে আমাদের ওপর সমাজের যে চাপ, তা অতিক্রম করে শিশুকে বোঝার মতো মন তৈরিতে অভিভাবকের সতর্ক চেষ্টা প্রয়োজন৷

কাহলিল জিবরান যেমনটা বলেছেন

‘‘তোমরা ওদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে পারো,

কিন্তু তোমরা যেমন-ওদের তেমন করে তুলতে চেয়ো না৷

কারণ জীবন কখনো পেছনে ফিরে যায় না৷’’