1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গান্ধীর দেশে আন্দোলন ও তার মোকাবিলা সহিংস পথেই

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
৪ আগস্ট ২০২৩

গান্ধীজির দেশে অধিকাংশ আন্দোলনই তো সহিংস৷ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে৷ স্বাধীনতার পর থেকেই৷

https://p.dw.com/p/4UlRx
মণিপুরের ঘটনার প্রতিবাদে বিরোধীদের মিছিলে পুলিশের বাধা
মণিপুরের ঘটনার প্রতিবাদে বিরোধীদের মিছিলে পুলিশের বাধাছবি: Rafiq Maqbool/AP Photo/picture alliance

মাত্র এক পয়সা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে কলকাতায় অনেকগুলি ট্রাম পুড়েছিল ৷  ১৯৫৩ সালের জুন মাসে সেই ভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে বামপন্থিদের রীতিমতো সহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল কলকাতা৷ প্রচুর মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ সেনা নেমেছিল৷ গুলিতে একজনের প্রাণ গেছিল৷ জ্যোতি বসুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত ৩১ জুলাই সেই এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়৷

এর ছয় বছর পরে শুরু হয় খাদ্য আন্দোলন৷ সেটাও বামপন্থিদের আন্দোলন৷ ক্রমশ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে৷ জেলায় জেলায় ছড়ায়৷ ৩১ অগাস্ট সবচেয়ে বড় আন্দোলন হলো কলকাতায়৷ অসংখ্য মানুষ এলেন৷ পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হলো৷ গ্যাস চললো৷ গুলি চললো৷ ৮০ জন মারা গেছিলেন৷

আবার ৬৬ সালে বড় সহিংস আন্দোলন হলো৷ ১১ ফেব্রুয়ারি বাম নেতৃত্ব খাদ্য, রেশন ব্যবস্থা ও কালোবাজারি নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিলেন৷ এরপর বসিরহাট, স্বরূপনগর, বারাসতে পুলিশ ও বামপন্থিদের সংঘর্ষ হলো৷ আবার মানুষ প্রাণ হারালেন৷ বাস পুড়লো৷

কিছুদিন পর ১০ মার্চ বামপন্থিদের ডাকা হরতালে আবার তাণ্ডব হলো৷ পুলিসের ভ্যান পুড়লো, গুলি চললো, বোমাবৃষ্টি হলো৷ আবার আন্দোলনে মৃত্যু দেখলো কলকাতা৷

সাধারণ মানুষের জন্য আন্দোলনে নেমে কেন যে ট্রাম-বাসের মতো সাধারণ মানুষের যান পোড়ানো হয় কে জানে৷ এর পিছনে কোনো যুক্তি নেই৷ আছে নিছক জঙ্গিপনা৷

তারপর এলো সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন৷ সেটাও তো আন্দোলন৷ তীব্র ও চরম সহিংস আন্দোলন৷ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান লেখা থাকত, 'বন্দুকের নল সব ক্ষমতার উৎস'৷ মূর্তি ভাঙা হতে লাগলো৷ বিদ্য়াসাগরের মূর্তিও বাদ গেল না৷ শুরু হলো অস্ত্র হাতে তরুণ ও যুবকদের আস্ফালন৷ গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা হবে৷ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় সে কী ভয়ের ছবি৷ গুলি, রক্ত, মৃত্যুর ছবি৷ আমি যে  স্কুলে পড়তাম সেখানে বোমা পড়লো৷ স্কুল বন্ধ হয়ে গেল৷ কতদিনের জন্য তা আর এখন মনে নেই৷  তার পাল্টা শুরু হলো পুলিশি তাণ্ডব৷ শুধু রক্তের আর মৃত্যুর ছবি দেখে ভীত ও ক্লান্ত পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার মানুষ৷ কলকাতা থেকে একটা অসম্ভব বুদ্ধিমান প্রজন্ম হয় এই আন্দোলনে গিয়ে শেষ হয়ে গেল বা চলে গেল বাইরে৷ ভারতের অন্য রাজ্যে বা বিদেশে৷ পশ্চিমবঙ্গে মধ্যমেধার রাজত্ব আরো জোরদার হলো তারপর থেকে৷

যত দিন গিয়েছে, আন্দোলনের নামে জঙ্গিপনা কমেনি৷ যে বামপন্থিরা এরকম আন্দোলন করার পর ক্ষমতায় এলেন, তারাই ক্ষমতা থাকার মাত্র দুই বছরের মধ্যে পুলিশকে দিয়ে মরিচঝাঁপিতে জোর করে শরণার্থীদের সরাবার চেষ্টা করলেন৷ সরকারিভাবে বলা হয়, গুলিতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে৷ কিন্তু বেসরকারি মতে সংখ্যাটা ৫০-এর বেশি৷ কারো দাবি তা একশ ছুঁয়েছিল৷

বাম আমলেও পুলিশ একইরকমভাবে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে গেছে৷ কংগ্রেস, তৃণমূল, এসইউসি ও অন্যদের আন্দোলন পুলিশ সেই লাঠি, গ্যাস, গুলি দিয়েই ভাঙার চেষ্টা করেছে৷ তার অন্যতম বড় উদাহরণ হলো ২১ জুলাইয়ের ঘটনা৷ ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই, সেই সময়ের যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে মহাকরণ অভিযানের ডাক দেন৷ কয়েক হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী রাস্তায় নামেন৷ পুলিশ সেদিনও গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে মেরেছিল৷ তার স্মরণে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিবছর ২১ জুলাই শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান করে৷

আবার এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তার দলের নেতারা বিধানসভায় ব্যাপক ভাঙচুর করেছিলেন বলে অভিযোগ৷ কারণ, তাদের সিঙ্গুর যেতে দেয়া হয়নি৷ এই সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলন নিয়েও তো কত কাণ্ড হয়েছে৷ সহিংসতার অভিযোগ, এলাকা দখল, পুলিশ দিয়ে অপারেশন সানশাইন সবকিছুই তো দেখেছি আমরা৷ আবার এখন তৃণমূল রাজত্বে চেখছি, বিরোধীরা কোনো আন্দোলন, মহাকরণ ঘেরাওয়ের ডাক দিলেই পুলিশ আগের মতোই লাঠি, গ্যাস চালায়৷ এই পুলিশের বিরুদ্ধেই তো ছাত্রনেতা আনিস খানকে ছাদের উপর থেকে ফেলে মেরে ফেলার অভিযোগ রয়েছে৷  আমরা বগটুই দেখেছি, পঞ্চায়েত ভোটের সময় বোমা-গুলির বৃষ্টি দেখেছি৷ তার বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন এবং সেখানেও বোমা-গুলি দেখেছি৷

যে বিজেপি নিজেদের শাসনে থাকা রাজ্যে সহিংস আন্দোলনের বিরোধিতা করে, কিছু হলেই উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে বুলডোজার পাঠিয়ে আন্দোলনকারীদের  বাড়ি দোকান ভেঙে দেয়া হয়, তারাই আবার পশ্চিমবঙ্গে একইরকমভাবে কট্টর আন্দোলনে নামে৷ মহাকরণ অভিযান থেকে তাদের মিছিলে ঘিরে তাই বিতর্ক তৈরি হয়৷

আর এখন এই টিভি ও ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে আন্দোলন মানেই তো এমন কিছু করা যাতে ভিডিও ভারতজুড়ে দেখানো হবে৷ নেতাদের বাইট নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরবে সংবাদমাধ্যম৷ আর টিভি -র সাংবাদিকদের প্রিয় প্রশ্ন হলো, এখন শাসক দলের এই নেতা এই কথা বলেছেন, আপনার কী প্রতিক্রিয়া৷ এবার সেই প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পরই আবার শাসক দলের নেতার কাছে দৌড়৷ বিরোধী দলের নেতা এই বলেছেন, আপনার কী প্রতিক্রিয়া৷ এসবই নাকি পাবলিক খায়৷ শুধু খায় নয়, গেলে৷ তাই বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি যে কোনো নিউজ চ্যানেলেই আপনি চোখ রাখুন, দেখবেন, সবাই ভয়ংকর চিৎকার করছেন৷  সংসদে আলোচনা হয় কই, শুধু তো স্লোগান দেয়া হয়৷ সর্বত্র এই উত্তেজনা৷ পুরো ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও সিনড্রোম৷

গৌতম হোড়, সাংবাদিক, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, সাংবাদিক, ডয়চে ভেলেছবি: privat

আন্দোলনেও তারই ছায়া পড়ে৷ রাস্তায় নামলেই পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা হবে৷ তারপর পুলিশ পেটাবে৷ ভালো ছবি উঠবে৷ টিভি-তে দেখাবে৷ কিছুদিন আগে কৃষক আন্দোলন আছড়ে পড়েছিল দিল্লিতে৷ পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সীমান্তে এসে বসে পড়েছিলেন কৃষকরা৷ কিন্তু তাদেরও প্রবলভাবে বাধা দেয়া হয়েছিল৷ তারা সেই বাধা টপকে দিল্লির সীমানায় আসতে পেরেছিলেন৷

ভারতের আন্দোলন এখন এরকমই৷ মাঝখানে আন্না হাজারে গান্ধীবাদী পথে আন্দোলনের চেষ্টা করেছিলেন৷ সেই আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ দিল্লিতে তার হাতে পুলিশ নেই৷ পাঞ্জাবে আপ সরকারের হাতে আছে৷ সেখানেও সম্প্রতি আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর ব্যাপক লাঠি চালিয়েছে পুলিশ৷

ফলে সেই অতীত থেকে এখন পর্যন্ত আন্দোলনের ফর্মুলাটা কী? লড়াই করতে হবে৷ জঙ্গিপনা দেখাতে হবে৷ আর ক্ষমতাসীন দল পুলিশকে দিয়ে সেই আন্দোলন ভাঙার জন্য বলপ্রয়োগ করবে৷ পুলিশ লাঠি চালাবে৷

নির্মমভাবে আন্দোলনকারীদের মারবে৷ কাঁদানে গ্যাস ছুড়বে৷ দরকার হলে গুলি চালাবে৷ আর যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণের মতো, যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তারা একই পদ্ধতিতে চলবেন৷ বিরোধীরা একইরকম জঙ্গি আন্দোলন করে যাবেন৷

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷