‘গভীর রাতেও শব্দ হলে মা দরজার দিকে ছুটে যান’
১০ ডিসেম্বর ২০১৭বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে রবিবার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে সবমবেত হয়েছিলে নিখোঁজ ও গুম হওয়া অন্তত ৩০টি পরিবারের সদস্যরা৷ তাদের শোক আর বেদনার ভাষা শুনে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি৷ সেখানে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয়ার পর ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন রেহানা বানু মুন্নি৷ তিনি বলেন, ‘‘পিন্টু সুত্রাপুর ছাত্রদলের সভাপতি ছিল৷ থাকতো পল্লবীর বাসায়৷ ২০১৩ সালে ডিবি পরিচয়ে ওই বাসা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ যারা তুলে নেয় তাদের সবার হাতে অস্ত্র ছিল৷ এরপর আমরা র্যাব পুলিশসহ প্রশাসনের উপর মহলে ধর্ণা দিয়েছি৷ কিন্তু তাঁর খোঁজ কেউ দিতে পারেনি৷''
তিনি বলেন, ‘‘পিন্টু নিখোঁজ হওয়ার পর আমার বাবা-মা শোকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ মা এখন অনেকটাই অপ্রকৃতিস্থ৷ গভীর রাতেও ঘরে কোনো শব্দ হলে, কিংবা কলিংবেলের শব্দ হলে মা ছুটে যান৷ ভাবেন এই বুঝি তাঁর ছেলে ফিরে এল৷ আমরা আমাদের মাকে এখনো শান্তনা দিয়ে রাখছি৷ তাকে বলি পিন্টুর খোঁজ পাওয়া গেছে৷ সে ফিরে আসবে৷ একেক সময় একেক গল্প বলি৷ কিন্তু পিন্টুতো আর ফিরে আসে না৷''
প্রেসক্লাবের ওই জমায়েতে ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানবাধিকারের এখন সবচেয়ে বড় সংকট হল অপহরণ, নিখোঁজ ও গুমের ঘটনা৷ এটা ক্রসফায়ারের চেয়েও ভয়াবহ৷ কারণ নিখোঁজ বা গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা ঠিক জানেন না নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা৷ সে আদৌ ফিরে আসবে কিনা৷ তাকে পাওয়া যাবে কিনা৷ পুরো একটি পরিবার দিনের পর দিন আতঙ্ক আর ট্রমার মধ্যে থাকে৷ সাত বছর পার না হলে নিখোঁজ ব্যক্তির ব্যাংকের টাকা বা সম্পদ কোনো কাজে ব্যবহারও করা যায়না৷''
তিনি বলেন, ‘‘যারা প্রেসক্লবে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলে কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে কোন ব্যক্তি গুম হয়নি বরং পুরো পরিবারটিই গুম হয়েছে৷ তারা কারুর সহায়তাও পাচ্ছেনা৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তাও পাওয়া যাচ্ছেনা৷ তাই নিখোঁজদের পরিবারের কেউ কেউ বিষয়টি এখন জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন৷''
বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার প্রতিবছর ‘মায়ের ডাক' ব্যানারে স্বজনদের সন্ধান দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে আসছেন এই দিনে৷ ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন ফেরদৌসী বলেন, ‘‘গত চার বছরে বিশবার দাঁড়িয়েছি ভাইয়ের খোঁজে৷ সবাই চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু কারুর কোরো চেষ্টা কাজে আসছে না৷ করো কি কোনো দায় নাই? কেউ কি বলবেন না আমাদের স্বজন কোথায় আছে? আমরা আর পারছি না৷ আমাদের ওপর দয়া করুন৷''
সভায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘আমরা গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি এ বছর প্রথম ছয়মাসে ৫২ জন গুম হয়েছে, ৮৭ জন ক্রসফায়ার হয়েছে৷ এসব বিষয়ে মানবাধিকার চেয়ারম্যান পুলিশের কাছে তথ্য চাইলে পুলিশ মানবাধিকারকে পাত্তা দিচ্ছে না৷ এবিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি একই উত্তর দিচ্ছেন৷ তিনি বিষয়টি খোঁজ নিবেন৷ অথচ আমাদের দেশে মানবতার মাতা বাস করেন৷''
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছর ১০ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন ৫৪৪ জন৷ তাদের মধ্যে ৩৯৫ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসেই নিখোঁজ হয়েছে ৫০ জন, যাদের ৩৮ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ আর গত ১০ মাসে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১৩৯ জন৷ চার বছরে নিহত হয়েছেন ৬৫৪ জন৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে ২০১৬ সালে ৯৭ জন নিখোঁজ হওয়ার পর ১১ জনের লাশ পাওয়া যায়৷ ২৬ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ আর তিনজন ফিরে আসে৷ বাকি ৫৭ জন এখনো নিখোঁজ৷ ২০১৫ সালে নিখোঁজ হন ৫৫ জন, যাঁদের মধ্যে আটজনের লাশ উদ্ধার করা হয়৷ সাতজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, ফিরে আসেন পাঁচজন৷ এখনো নিখোঁজ আছেন ৩৫ জন৷
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের অবস্থান জানাতে হবে৷ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷ একজন নাগরিক নিখোঁজ হয়ে যাবেন আর রাষ্ট্র তাঁর খোঁজ দিতে পারে না, এটা গ্রহণযোগ্য নয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় এধরনের জঘন্য অপরাধের বিচার না হলে রাষ্ট্র চরম অধঃপতনে চলে যায়৷ রাষ্ট্রই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে৷ আর এর দায় এড়ানো যায়না৷ একদিন না একদিন বিচার হতেই হয়৷''