গণহারে মামলা : নতুন আশ্বাস, পুরনো চিত্র
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪পুলিশের আইজি মো. ময়নুল ইসলাম সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য মামলাগুলো পুলিশ সদর দপ্তর মনিটরিং করছে৷ যারা অপরাধ করেছেন, তাদেরই আইনের আওতায় নেয়া হবে৷''
পুলিশ সদর দপ্তর ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে ৫ আগস্টের পর থেকে রবিবার পর্যন্ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সারা দেশে এক হাজার ১৩টি মামলা হয়েছে৷ তবে ওইসব মামলায় ঠিক কত জন আটক হয়েছেন তার হিসেব নেই তাদের কাছে৷ যেসব মামলা হয়েছে তার অধিকাংশই হত্যা মামলা৷ তবে এর বাইরে কিছু হামলা, ভাঙচুরসহ অন্যান্য অভিযোগের মামলাও রয়েছে৷
জানা গেছে, এসব মামলা হয়েছে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, পুলিশহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির লোকজনের বিরুদ্ধে৷ তাদের বিরুদ্ধে মূলত গণহত্যা, হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে৷ এই তালিকায় অভিনেতা, খেলোয়াড়সহ এমন কিছু সেলিব্রেটিও রয়েছেন, যারা গণ আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন অথবা হত্যার প্রতিবাদ না করে নীরব থেকেছেন৷
এখন পর্যন্ত মোট মামলার মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই ১৭৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে৷ ১৭৭টির মধ্যে ১৫৭টিই হত্যা মামলা৷ এসব মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে৷ মামলা হয়েছে পুলিশের ৩৮৮ জন সদস্যের বিরুদ্ধেও৷
গ্রেপ্তারের তালিকাও ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে৷ সেই তালিকায় সাবেক সরকারের মন্ত্রীসহ কমপক্ষে ৩০ জন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকের সঙ্গে বিভিন্ন পেশার অনেকের নামই রয়েছে৷
এই গণ মামলা ও হত্যা মামলার প্রেক্ষাপটে গত ৩০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়৷ অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে৷''
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাইনুল হাসান গতকাল (১৫ সেপ্টেম্বর) বলেছেন, ‘‘মামলার এজাহারে নাম থাকলেই গ্রেপ্তার করতে হবে বিষয়টা এ রকম না৷ কালেক্টিভ তদন্ত করে তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷''
পুলিশের আইজি মো. ময়নুল ইসলাম রবিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মামলা তো করেছে৷ কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আমরা মামলাগুলো ক্লোজ মনিটরিং করছি৷ এখানে রাজনৈতিক নেতা, সরকাারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, পুলিশ অফিসারসহ যাদের আসামি করা হয়েছে, সবার ব্যাপারেই তদন্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে৷ এখন তো নানা সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া যায়, ভিডিও আছে৷ আমরা সেভাবে কারা অপরাধে জড়িত, তা নিশ্চিত হচ্ছি৷ কেউ যেন হয়রানির মুখে না পড়ে৷ আবার আমাদের লোকজন যাতে কাউকে হয়রানি না করে, সেগুলো আমরা দেখছি৷ আবার যারা প্রকৃতই অপরাধ করেছে, তারা যাতে রেহাই না পায়, সেটাও আমরা দেখবো৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও হত্যাসহ (বিভিন্ন অভিযোগে) মামলা হচ্ছে৷ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷ তাদের মামলাগুলোও মনিটরিং করা হচ্ছে৷ কেউ যদি অপরাধী না হন, তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে না৷ সাংবাদিকদের যেন প্রফেশনাল কাজের জন্য হয়রানি করা না হয়, সেগুলো আমরা দেখছি৷''
তবে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘আসলে মামলা নেয়ার আগেই পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত করে মামলা নেয়া উচিত৷ পুলিশ এটা চাইলেই করতে পারে৷ তা না হলে এই যে গণহারে হত্যা মামলা হচ্ছে, তা থামানো যাবে না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘গণহত্যা, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ অনেক ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটেছে৷ যারা এইসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করতে হবে৷ সেটা না করে এই যে ঢালাও হত্যা মামলা হচ্ছে, তাতে মামলার মেরিট নষ্ট হতে পারে এবং মূল অপরাধীরা আড়ালে চলে যেতে পারে৷ আসামি এমনভাবে দেয়া হচ্ছে, তাতে কথা উঠছে যে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিদেরও আসামি করা হচ্ছে৷''
তার কথা, ‘‘৫ আগস্টের পর বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে৷ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমরা যেমন মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা হতে দেখেছি৷''
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক মনে করেন, ‘‘পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মামলা হলেই সবাইকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না- তদন্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে৷ এটা গুড সাইন৷ তবে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা অপরাধী নন, তারা কিন্তু আদালতের মাধ্যমে খালাস পাবেন৷ আর দেশে গণহত্যা, দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ অনেক অপরাধ হয়েছে৷ সেই মামলাগুলো করতে হয়তো একটু সময় দরকার৷ ফলে তারা যাতে পালাতে না পারে, সেইজন্য এই সব মামলার মাধ্যমে একটা ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনা হচ্ছে৷''
ওতবে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘আমি সবসময়ই এইসব গণহারে মামলার বিরোধী৷ এর বিরুদ্ধে অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে৷''
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গণহারে হত্যা-মামলার নিন্দা
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ৷ অভিযুক্ত সাংবাদিকদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে এসব মামলা থেকে দ্রুত তাদের অব্যাহতি দেয়ার আহবানও জানিয়ে দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের এই সংগঠনটি৷
শনিবার পরিষদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের মামলা দেওয়ার প্রবণতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করছে৷
পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বিবৃতিতে আরো বলেন, ‘‘সাংবাদিকরা কোনো অপরাধ করে থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ ধারা অনুসরণ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে৷ সম্পাদক পরিষদ আরো জোর দিয়ে বলতে চায় যে, পেশাদারিত্ব বাদ দিয়ে নীতিবিবর্জিত ও লেজুড়বৃত্তির সাংবাদিকতা বর্জনীয়৷''