গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দড়ি টানাটানি
৩ মে ২০২২বার্লিনের অফিস, অর্থাৎ আমি এখন যেখানে কাজ করি, সেখানে বিশ্ব রাজনীতির উত্তাপটা সহজেই টের পাওয়া যায়৷ ছয় বছর আগে যখন এখানে আসি, আমার সহকর্মীরা তুরস্কের আরোপ করা অসংখ্য সেন্সরশিপের গল্প শুনেছিলেন৷
তরুণ এক পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট তখন মিশরের আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসন থেকে পালিয়ে কায়রোয় যে সামরিক নিপীড়ন চলছে সেদিকে আমাদের মনযোগ কাড়লেন৷ নাগর্নো-কারাবাখ সংকটের ফলে বাকুর সহকর্মীরাও তখন দরজায় কড়া নাড়ছেন৷ হাঙ্গেরির সবচেয়ে বড় সংবাদপত্রটিও বন্ধ করে দেয়া হলো, আমরা তার এডিটর-ইন-চিফকে স্বাগত জানালাম৷
আজকাল আমার প্রতিবেশী কে বলতে পারেন? একজন শান্তিপ্রিয় রুশ সাংবাদিক! আমার অফিসটা কেমন আশা করি তা এখন কল্পনা করতে পারছেন৷
আমরা সবাই কিন্তু আমাদের নিজস্ব মত এবং প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছি৷ তবে দেশ ছাড়তে হলেও দমে যাইনি বরং নির্বাসিতের জীবনেও সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷ আমাদের মধ্যে যারা একটু পুরোনো, মানে যারা এখানে বেশ আগে এসেছি, তারা সবসময় প্রবাসে সাংবাদিকতা করে যা যা শিখেছি সব নবাগতদের বলি৷
আমাদের কথোপকথনে উঠে আসে বিশ্বব্যাপী সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দুরবস্থার ভয়াবহ চিত্র৷
‘‘আচ্ছা, কোন প্রতিবেদনের জন্য আপনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন?''
‘‘কতিদন (জেলের) ভেতরে ছিলেন?''
‘‘কেমন করে পালালেন?''
‘‘দেশে কখনো ফিরবেন বলে মনে হয় আপনার?''
এসবের পরে শুরু হয় কী কী উপায়ে সেন্সরশিপের দেয়াল ডিঙিয়ে আমাদের কথা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি তা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা৷ কথা হয় কোন কৌশল অবলম্বন করলে নিষিদ্ধ করা প্রতিবেদন পাঠকের কাছে নিয়ে যেতে পারি, কেমন করে গোয়েন্দা বিভাগকে বোকা বানিয়ে কাজ করা যায় সেসব নিয়ে৷
বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকে পূর্ণ আমাদের অফিসের দিকে তাকালেও বিশ্বের কোন কোন দেশে সাংবাদিকের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে৷ আমরা যেমন করে একজন আরেকজনকে সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে শেখাই, সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হয়, সারা বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকেরাও যেন সেভাবে একজন আরেকজনকে অনুকরণ করে৷ নিজেদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করতে প্রায় একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করে তারা৷ প্রথমে মুখের এবং লেখার শব্দ বন্ধ করতে সংবাদমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করো, কারণ, মূক ও বধির করে রাখা জনগণকে শাসন করা অনেক সহজ৷
পাশ্চাত্যের দেশগুলোর দিকেও তাকান৷
ভাবুন একবার, ওয়াশিংটনে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে যা-তা বলতে শুরু করলেন, তার সমালোচনা করেন এমন সাংবাদিকদের হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে নিষিদ্ধ করলেন৷ ওদিকে লন্ডনে হুইসেল ব্লোয়ার জুলিয়ান আসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করা হলো৷ প্যারিসে যে সাংবাদিকরা ‘ইয়েলো ভেস্ট' পরা বিক্ষোভকারীদের ছবি তুলতে গেলেন, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হলো৷
একেবারে কোভিড -১৯ সেন্সরশিপ যেভাবে দাবদাহের মতো সীমান্ত থেকে সীমান্তে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে, এক শাসন থেকে অন্য শাসনে ছড়িয়ে পড়েছিল, অনেকটা সেরকম অবস্থাই তো!
আগে আমাদের পশ্চিমা সহকর্মীরা জানতে চাইতেন, ‘‘ আপনার জন্য আমরা কী করতে পারি?'' হঠাৎ এমন অবস্থা হয়ে গেল যে আমরা এখন জানতে চাইছি, ‘‘আমরা এক হয়ে কী করতে পারি?''
হঠাৎ আমরা অনুধাবন করি, আসলে সমষ্টিগতভাবে অনেক কিছুই করার আছে৷ নানা দেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন বাড়তে থাকায় অনেক সাংবাদিক যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তার একটা ভালো দিকও আছে কিন্তু৷ এর ফলে নির্বাসিত সাংবাদিকরা পশ্চিমা দেশগুলোর রাজধানীতে থেকে সাংবাদিকতা করার সুযোগ পেয়েছেন আর তাতে নিপীড়নমূলক শাসনের কথা ইউরোপসহ বাইরের দুনিয়া আরো বেশি জানতে পেরেছে৷ পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও আগের চেয়ে বেড়েছে৷
বিশ্বে যেভাবে চিন্তার স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ হচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়াটাও বিশ্বব্যাপীই হওয়া উচিত৷ এভাবেই সাংবাদিকতা সব সীমানা, সব বাধা অতিক্রম করতে পারে৷
স্বৈরাচারীরা হয়ত একতাবদ্ধ হয়ে বিরোধীদের দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের নতুন কৌশল অবলম্বন শুরু করবে, তা সত্ত্বেও তাদের গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, নোংরা যুদ্ধ কৌশল এবং টেলিফোনে আড়িপাতা বা বিরোধীদের দেহে বিষ প্রয়োগের মতো জঘন্য কাজগুলোর কথা সবাইকে জানাতে হবে৷
দিন দিন সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক বড় হচ্ছে৷ সব দমন এবং সেন্সরশিপের বাধা অগ্রাহ্য করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং তথ্যের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইও জোরদার হচ্ছে৷
এই দড়ি টানাটানিই হয়ত আগামীর পৃথিবীর গতিপথ নির্ধারণ করবে৷