খেলাধুলা না থাকায় শিশুরা পরাজয় মানতে শিখছে না
১৬ ডিসেম্বর ২০২২এর মধ্যে তিনজন তো প্রতিপক্ষের সমর্থকদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন৷ খেলা নিয়ে কেন এই উগ্রতা, কেন এই হিংস্র আচরণ? কেন আমরা পরাজয় মেনে নিতে শিখছি না? ডয়চে ভেলের কাছে এসব প্রশ্নের ব্যাখা দিয়েছেন প্রখ্যাত মনোবিদ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম৷
ডয়চে ভেলে : বিশ্বকাপ ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা তো আপনি নিশ্চয় খেয়াল করছেন৷ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থন নিয়ে আমরা মাঝে মধ্যে হিংস্র আচরণ দেখছি, এর কারণ কি?
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম : এই হিংস্র আচরণ আসছে আবেগ থেকে৷ কোনো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্রেনে একটা ভাবনা কাজ করে৷ এ ব্যাপারে আমরা সচেতন থাকি না, দ্রুত জিনিসগুলো ব্রেনের মধ্যে ঘটতে থাকে৷ মানুষের মস্তিষ্কে যে জিনিসগুলো কাজ করে সেটা নিয়েই যেহেতু আমি কাজ করি, সেই জায়গা থেকেই বলছি, কিছু একটা ঘটলে আমাদের ব্রেন সেটা নিয়ে চিন্তা করে৷ এটা কেন হল, কীভাবে হল, না হলেও তো পারত এ ধরনের কিছু চিন্তা কাজ করে৷ কেউ যদি খারাপ আচরণ করে সেই মানুষটাকে নিয়েও ভাবনা কাজ করে৷ তিনি কেন এটা করলেন, আমার সঙ্গে কীভাবে এটা করতে পারলো এই ধরনের কিছু চিন্তা কাজ করে৷ নেগেটিভ কিছু ঘটলে নেগেটিভ চিন্তা মাথায় আসে, আর পজেটিভ কিছু ঘটলে পজেটিভ চিন্তা মাথায় আসে৷ এরপরে যে ঘটনাটা ঘটে, সেটা হল আবেগ৷ পজেটিভ কিছু ঘটলে খুশি লাগে, সুখানুভূতি হয় তখন উল্লাস করতে ইচ্ছে করে৷ নেগেটিভ কিছু ঘটলে নেতিবাচক ফিলিং কাজ করে৷ যেমন খুব রাগ কাজ করে, বিরক্তি কাজ করে, খুব ভয় কাজ করে, খুব অসহায়ত্ব কাজ করে এমন উপলদ্ধি হয়৷ এই উপলদ্ধির রেজাল্টই হচ্ছে আচরন৷ সেটাই আমরা বাইরে থেকে দেখছি৷
এক দলের সমর্থকেরা অন্য দলের কোন সমর্থককে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না, এমন উগ্র আচরণের কোনো ব্যাখ্যা আছে?
আমি যদি বাঙালি জাতি হিসেবে চিন্তা করি, আমরা তো বদ্বীপের অধিবাসী৷ আমরা যদি ইতিহাস বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, প্রকৃতির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের টিকে থাকতে হয়েছে৷ বদ্বীপের অধিবাসী হিসেবে আমাদের মধ্যে সাধারণভাবে একটু হিংস্রতা আছে৷ আমরা শুনছি, চর দখল নিয়ে আমরা কাউকে হত্যা করে ফেলছি৷ জমি নিয়ে আমাদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে৷ দখলের বিষয়টি বাঙালির ইতিহাসে অনেক বেশি আছে৷ রাজনৈতিক জায়গায় যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির আদর্শ হয়ত আমি বুঝিও না৷ কিন্তু আবেগপ্রবণ হয়ে আমি একটা দলকে সাপোর্ট করছি৷ এই আবেগের পেছনে কী কারণ সেটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ কথা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে এই হিংস্রতা কেন? এই বদ্বীপের বাসিন্দারা প্রতিনিয়তই জীবন নিয়ে যুদ্ধের মধ্যে দিন পার করেছেন৷ নদী ভাঙনে বাড়ি গেছে, অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করতে হয়েছে৷ নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের মধ্যে কম ছিল৷ এটা একটা কারণ৷ আরেকটা কারণ হল, আমাদের লেখাপড়ার সিস্টেমে বড় একটা ঘাটতি রয়েছে৷ শিক্ষিত বলতে আমি ডিগ্রির কথা বলছি না৷ বাচ্চাদের রেজাল্ট নিয়ে আমরা খুশি হচ্ছি, কিন্তু আমার বাচ্চাটা জীবন দক্ষতা নিয়ে কতটা বড় হচ্ছে, সেটা কিন্তু দেখছি না৷ ডাব্লিউএইচও ১০টি দক্ষতার কথা বলেছে৷ আমাদের এই দক্ষতাটা অর্জন করা হচ্ছে না৷ বই মুখস্থ করে আমাদের বাচ্চারা পরীক্ষা দিচ্ছে৷ জীবনে চলার জন্য যে দক্ষতা সেটা কিন্তু আমরা দেখছি না৷ প্রেম ভালবাসার কথা আমাকে শুনতে হয়৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মারামারি কাটাকাটির কথা আমাকে শুনতে হয়৷ হয়ত শারীরিকভাবে আঘাত না করলেও মানসিকভাবে আঘাত করছে৷ নানা সংকটে নিজেকে ম্যানেজ করার যে মানসিকতা সেটা আমরা তৈরি করতে পারিনি৷
আমরা কেন পরাজয় মেনে নিতে পারছি না৷ সব সময় কেন জয়ী হতে চাই?
সবাই তো জিততে চাই৷ জেতার আনন্দ সবাই পেতে চাই৷ কোন স্কুলে এখন বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা নেই৷ খেলা কিন্তু বড় একটা মাধ্যম৷ আমরা যদি বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম তাহলে তারা পরাজয়কে মানতে শিখত৷ পরাজয় মেনে আবার জয়ী হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি সেটা তারা খেলার মাধ্যমেই শিখতে পারত৷ আমাদের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায় খুব ছোটবেলা থেকেই৷ যখন কুড়ি থেকে ফুলে রূপান্তরিত হয়নি তখন জেতার আনন্দের পাশাপাশি হেরে গেলে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময়৷ সেটা আমরা বাচ্চাদের শেখাতে পারিনি৷
অনেক সময় কী এমন হয়, জমি-জমা বা অন্য কোন বিরোধে আগে থেকেই রাগ বা ক্ষোভ ছিল, বিশ্বকাপের উন্মাদনার নামে পূর্বপরিকল্পিত ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে হত্যাকাণ্ড ঘটছে?
এটা কিন্তু সুযোগ নিচ্ছে৷ হঠাৎ করে আবেগের মধ্যে পড়ে গিয়ে করছে না৷ মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন যদি আমার তার উপর রাগ থাকে তখন আমি সুযোগটা নিয়ে নেই৷ এটা হয়৷ কিন্তু বলা হয়, আমি তো বিশ্বকাপের উন্মাদনায় ছিলাম তখন আবেগে পড়ে করে ফেলেছি৷ এটা অবেচেতন মন থেকে করছে না, এটা পরিকল্পিতভাবে করছে৷ সুযোগ খুঁজছিল, সেই সুযোগ পেয়ে গেছে মনে করেই করছে৷
আমাদের এমন উগ্র বা হিংস্র আচরণের জন্য কি বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো দায় আছে?
অর্থনৈতিক সূচক দিয়ে কিন্তু উন্নয়ন মাপা যায় না৷ উন্নয়ন হচ্ছে মানব উন্নয়ন৷ আমার মানসিকতার উন্নয়ন হচ্ছে কিনা, ভদ্রতা রক্ষা করে চলতে পারছি কিনা৷ আমাদের প্যারেন্টিংয়ের মধ্যেও বড় একটা ঘাটতি রয়েছে৷ আমরা যে বিয়ে করি, আমরা জানি না, স্বামী স্ত্রী হিসেবে আমরা কীভাবে ভালো থাকব৷ এ ব্যাপারে কিন্তু কোন ধারণা থাকে না৷ অনেক পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে মারামারি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে৷ বাচ্চাদের কাছে জানতে চাইলে এটাকেই তারা নরমাল বলে৷ আমি তো নেগেটিভ স্টোরিগুলো বেশি শুনি তাই আমার কথাগুলো একপেশে মনে হতে পারে৷ সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষাটাও অনেক সময় বাবা মায়ের থাকে না৷ ইউরোপ যখন বাচ্চাকে স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আসল তখন কিন্তু তারা বলেছিল, বাচ্চা যেন শুধু ইংরেজি, অংক এগুলো না শিখে সার্বিক বিকাশ ঘটাতে হবে৷ তখন কিন্তু স্কুল সেই দায়িত্ব নিয়েছে৷ আমরা কিন্তু অনুন্নত রয়ে গেছি৷ টাকা পয়সা থাকলেই মানুষ উন্নত হয় না৷ আমাদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন ঘটেনি৷
আমরা অনেক সময় দেখি, ফুটবল বিশ্বকাপে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা দলের সমর্থন করে আমরা পতাকা বানাচ্ছি, বাড়িতে সেই পতাকার রঙে রঙ করছি৷ পছন্দের দল জিতলে মানুষের পেছনে অনেক টাকা খরচ করছি৷ কিন্তু প্রতিবেশী অথচ গরিব কাউকে সহায়তার জন্য কোন অর্থ দিচ্ছি না৷ আমাদের মানসিকতা এমন কেন?
এটাও কিন্তু আমরা মনের দারিদ্র্য থেকে করছি৷ টাকা পয়সা মানে ধনী না৷ আমার মনটাতো আগে ধনী হতে হবে৷ ডাব্লিউএইচও যে ১০টা দক্ষতার কথা বলেছে সেটা কিন্তু চমৎকার৷ সেগুলো কিন্তু আমাদের শেখানো হয়নি৷ এই যে আমরা বিয়ের অনুষ্ঠান করছি, মানুষকে খাওয়াচ্ছি৷ কাদের খাওয়াচ্ছি, যাদের ভালো খাওয়ার সুযোগ আছে তাদের৷ অথচ প্লেট হাতে বাড়ির বাইরে যে মানুষগুলো বসে থাকেন তাদের কিন্তু আমরা উচ্ছিষ্ট দিচ্ছি৷ আমাদের সাংঘাতিকভাবে মনের দৈন্য রয়ে গেছে৷
খেলা নিয়ে আমাদের এই নেতিবাচক মানসিকতা কীভাবে পরিবর্তন হতে পারে?
খেলা নিয়ে উন্মাদনা আমি নেতিবাচকভাবে দেখছি না৷ খেলা কিন্তু খুব পজেটিভ একটা জিনিস৷ উন্মাদনা ঠিক আছে, কিন্তু খেলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি আমরা৷ ক্রিকেট নিয়ে তো করছি না, তাহলে ফুটবল নিয়ে কেন করছি? এমন প্রশ্ন আসতে পারে৷ ক্রিকেটটা একটু শিক্ষিত যারা তারা দেখছে৷ কিন্তু ফুটবলটা সবাই দেখছে৷ ফুটবল গ্রামগঞ্জের খেলা৷ ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, বৃষ্টির মধ্যে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলা হচ্ছে৷ কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে ক্রিকেট খেলা যায় না৷ ক্রিকেট খেলতে অনেক জিনিসপত্র লাগে৷ বল লাগে, স্টাম্প লাগে, ব্যাট লাগে আরও অনেক কিছু লাগে৷ একটু খরচের ব্যাপারও আছে৷ ফুটবল কিন্তু কোনো কিছু দিয়ে বানিয়েও খেলা যায়৷ ফুটবলের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে৷ ফলে ফুটবলে গোটা বাংলাদেশ উন্মাদ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটছে৷ হিংস্রতা বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির মধ্যে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিন্তু উন্মাদনাকে আমি খারাপভাবে দেখছি না৷ কাউকে মেরে ফেলার যে ঘটনা ঘটছে সেটা অবশ্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়৷