1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খেলাধুলা না থাকায় শিশুরা পরাজয় মানতে শিখছে না

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৬ ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল দলের সমর্থন নিয়ে বিভক্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ সমর্থক৷ দুই দলের সমর্থন নিয়ে এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4L2TS
মনোবিদ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
মনোবিদ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানমছবি: privat

এর মধ্যে তিনজন তো প্রতিপক্ষের সমর্থকদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন৷ খেলা নিয়ে কেন এই উগ্রতা, কেন এই হিংস্র আচরণ? কেন আমরা পরাজয় মেনে নিতে শিখছি না? ডয়চে ভেলের কাছে এসব প্রশ্নের ব্যাখা দিয়েছেন প্রখ্যাত মনোবিদ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম৷ 

ডয়চে ভেলে : বিশ্বকাপ ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা তো আপনি নিশ্চয় খেয়াল করছেন৷ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থন নিয়ে আমরা মাঝে মধ্যে হিংস্র আচরণ দেখছি, এর কারণ কি?

অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম : এই হিংস্র আচরণ আসছে আবেগ থেকে৷ কোনো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্রেনে একটা ভাবনা কাজ করে৷ এ ব্যাপারে আমরা সচেতন থাকি না, দ্রুত জিনিসগুলো ব্রেনের মধ্যে ঘটতে থাকে৷ মানুষের মস্তিষ্কে যে জিনিসগুলো কাজ করে সেটা নিয়েই যেহেতু আমি কাজ করি, সেই জায়গা থেকেই বলছি, কিছু একটা ঘটলে আমাদের ব্রেন সেটা নিয়ে চিন্তা করে৷ এটা কেন হল, কীভাবে হল, না হলেও তো পারত এ ধরনের কিছু চিন্তা কাজ করে৷ কেউ যদি খারাপ আচরণ করে সেই মানুষটাকে নিয়েও ভাবনা কাজ করে৷ তিনি কেন এটা করলেন, আমার সঙ্গে কীভাবে এটা করতে পারলো এই ধরনের কিছু চিন্তা কাজ করে৷ নেগেটিভ কিছু ঘটলে নেগেটিভ চিন্তা মাথায় আসে, আর পজেটিভ কিছু ঘটলে পজেটিভ চিন্তা মাথায় আসে৷ এরপরে যে ঘটনাটা ঘটে, সেটা হল আবেগ৷ পজেটিভ কিছু ঘটলে খুশি লাগে, সুখানুভূতি হয় তখন উল্লাস করতে ইচ্ছে করে৷ নেগেটিভ কিছু ঘটলে নেতিবাচক ফিলিং কাজ করে৷ যেমন খুব রাগ কাজ করে, বিরক্তি কাজ করে, খুব ভয় কাজ করে, খুব অসহায়ত্ব কাজ করে এমন উপলদ্ধি হয়৷ এই উপলদ্ধির রেজাল্টই হচ্ছে আচরন৷ সেটাই আমরা বাইরে থেকে দেখছি৷

‘বদ্বীপের অধিবাসী হিসেবে আমাদের মধ্যে সাধারণভাবে একটু হিংস্রতা আছে’

এক দলের সমর্থকেরা অন্য দলের কোন সমর্থককে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না, এমন উগ্র আচরণের কোনো ব্যাখ্যা আছে?

আমি যদি বাঙালি জাতি হিসেবে চিন্তা করি, আমরা তো বদ্বীপের অধিবাসী৷ আমরা যদি ইতিহাস বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, প্রকৃতির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের টিকে থাকতে হয়েছে৷ বদ্বীপের অধিবাসী হিসেবে আমাদের মধ্যে সাধারণভাবে একটু হিংস্রতা আছে৷ আমরা শুনছি, চর দখল নিয়ে আমরা কাউকে হত্যা করে ফেলছি৷ জমি নিয়ে আমাদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে৷ দখলের বিষয়টি বাঙালির ইতিহাসে অনেক বেশি আছে৷ রাজনৈতিক জায়গায় যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির আদর্শ হয়ত আমি বুঝিও না৷ কিন্তু আবেগপ্রবণ হয়ে আমি একটা দলকে সাপোর্ট করছি৷ এই আবেগের পেছনে কী কারণ সেটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ কথা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে এই হিংস্রতা কেন? এই বদ্বীপের বাসিন্দারা প্রতিনিয়তই জীবন নিয়ে যুদ্ধের মধ্যে দিন পার করেছেন৷ নদী ভাঙনে বাড়ি গেছে, অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করতে হয়েছে৷ নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের মধ্যে কম ছিল৷ এটা একটা কারণ৷ আরেকটা কারণ হল, আমাদের লেখাপড়ার সিস্টেমে বড় একটা ঘাটতি রয়েছে৷ শিক্ষিত বলতে আমি ডিগ্রির কথা বলছি না৷ বাচ্চাদের রেজাল্ট নিয়ে আমরা খুশি হচ্ছি, কিন্তু আমার বাচ্চাটা জীবন দক্ষতা নিয়ে কতটা বড় হচ্ছে, সেটা কিন্তু দেখছি না৷ ডাব্লিউএইচও ১০টি দক্ষতার কথা বলেছে৷ আমাদের এই দক্ষতাটা অর্জন করা হচ্ছে না৷ বই মুখস্থ করে আমাদের বাচ্চারা পরীক্ষা দিচ্ছে৷ জীবনে চলার জন্য যে দক্ষতা সেটা কিন্তু আমরা দেখছি না৷ প্রেম ভালবাসার কথা আমাকে শুনতে হয়৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মারামারি কাটাকাটির কথা আমাকে শুনতে হয়৷ হয়ত শারীরিকভাবে আঘাত না করলেও মানসিকভাবে আঘাত করছে৷ নানা সংকটে নিজেকে ম্যানেজ করার যে মানসিকতা সেটা আমরা তৈরি করতে পারিনি৷ 

আমরা কেন পরাজয় মেনে নিতে পারছি না৷ সব সময় কেন জয়ী হতে চাই?

সবাই তো জিততে চাই৷ জেতার আনন্দ সবাই পেতে চাই৷ কোন স্কুলে এখন বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা নেই৷ খেলা কিন্তু বড় একটা মাধ্যম৷ আমরা যদি বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম তাহলে তারা পরাজয়কে মানতে শিখত৷ পরাজয় মেনে আবার জয়ী হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি সেটা তারা খেলার মাধ্যমেই শিখতে পারত৷ আমাদের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায় খুব ছোটবেলা থেকেই৷ যখন কুড়ি থেকে ফুলে রূপান্তরিত হয়নি তখন জেতার আনন্দের পাশাপাশি হেরে গেলে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময়৷ সেটা আমরা বাচ্চাদের শেখাতে পারিনি৷

অনেক সময় কী এমন হয়, জমি-জমা বা অন্য কোন বিরোধে আগে থেকেই রাগ বা ক্ষোভ ছিল, বিশ্বকাপের উন্মাদনার নামে পূর্বপরিকল্পিত ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে হত্যাকাণ্ড ঘটছে?

এটা কিন্তু সুযোগ নিচ্ছে৷ হঠাৎ করে আবেগের মধ্যে পড়ে গিয়ে করছে না৷ মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন যদি আমার তার উপর রাগ থাকে তখন আমি সুযোগটা নিয়ে নেই৷ এটা হয়৷ কিন্তু বলা হয়, আমি তো বিশ্বকাপের উন্মাদনায় ছিলাম তখন আবেগে পড়ে করে ফেলেছি৷ এটা অবেচেতন মন থেকে করছে না, এটা পরিকল্পিতভাবে করছে৷ সুযোগ খুঁজছিল, সেই সুযোগ পেয়ে গেছে মনে করেই করছে৷

আমাদের এমন উগ্র বা হিংস্র আচরণের জন্য কি বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো দায় আছে?

অর্থনৈতিক সূচক দিয়ে কিন্তু উন্নয়ন মাপা যায় না৷ উন্নয়ন হচ্ছে মানব উন্নয়ন৷ আমার মানসিকতার উন্নয়ন হচ্ছে কিনা, ভদ্রতা রক্ষা করে চলতে পারছি কিনা৷ আমাদের প্যারেন্টিংয়ের মধ্যেও বড় একটা ঘাটতি রয়েছে৷ আমরা যে বিয়ে করি, আমরা জানি না, স্বামী স্ত্রী হিসেবে আমরা কীভাবে ভালো থাকব৷ এ ব্যাপারে কিন্তু কোন ধারণা থাকে না৷ অনেক পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে মারামারি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে৷ বাচ্চাদের কাছে জানতে চাইলে এটাকেই তারা নরমাল বলে৷ আমি তো নেগেটিভ স্টোরিগুলো বেশি শুনি তাই আমার কথাগুলো একপেশে মনে হতে পারে৷ সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষাটাও অনেক সময় বাবা মায়ের থাকে না৷ ইউরোপ যখন বাচ্চাকে স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আসল তখন কিন্তু তারা বলেছিল, বাচ্চা যেন শুধু ইংরেজি, অংক এগুলো না শিখে সার্বিক বিকাশ ঘটাতে হবে৷ তখন কিন্তু স্কুল সেই দায়িত্ব নিয়েছে৷ আমরা কিন্তু অনুন্নত রয়ে গেছি৷ টাকা পয়সা থাকলেই মানুষ উন্নত হয় না৷ আমাদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন ঘটেনি৷

আমরা অনেক সময় দেখি, ফুটবল বিশ্বকাপে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা দলের সমর্থন করে আমরা পতাকা বানাচ্ছি, বাড়িতে সেই পতাকার রঙে রঙ করছি৷ পছন্দের দল জিতলে মানুষের পেছনে অনেক টাকা খরচ করছি৷ কিন্তু প্রতিবেশী অথচ গরিব কাউকে সহায়তার জন্য কোন অর্থ দিচ্ছি না৷ আমাদের মানসিকতা এমন কেন?  

এটাও কিন্তু আমরা মনের দারিদ্র্য থেকে করছি৷ টাকা পয়সা মানে ধনী না৷ আমার মনটাতো আগে ধনী হতে হবে৷ ডাব্লিউএইচও যে ১০টা দক্ষতার কথা বলেছে সেটা কিন্তু চমৎকার৷ সেগুলো কিন্তু আমাদের শেখানো হয়নি৷ এই যে আমরা বিয়ের অনুষ্ঠান করছি, মানুষকে খাওয়াচ্ছি৷ কাদের খাওয়াচ্ছি, যাদের ভালো খাওয়ার সুযোগ আছে তাদের৷ অথচ প্লেট হাতে বাড়ির বাইরে যে মানুষগুলো বসে থাকেন তাদের কিন্তু আমরা উচ্ছিষ্ট দিচ্ছি৷ আমাদের সাংঘাতিকভাবে মনের দৈন্য রয়ে গেছে৷

খেলা নিয়ে আমাদের এই নেতিবাচক মানসিকতা কীভাবে পরিবর্তন হতে পারে?

খেলা নিয়ে উন্মাদনা আমি নেতিবাচকভাবে দেখছি না৷ খেলা কিন্তু খুব পজেটিভ একটা জিনিস৷ উন্মাদনা ঠিক আছে, কিন্তু খেলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি আমরা৷ ক্রিকেট নিয়ে তো করছি না, তাহলে ফুটবল নিয়ে কেন করছি? এমন প্রশ্ন আসতে পারে৷ ক্রিকেটটা একটু শিক্ষিত যারা তারা দেখছে৷ কিন্তু ফুটবলটা সবাই দেখছে৷ ফুটবল গ্রামগঞ্জের খেলা৷ ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, বৃষ্টির মধ্যে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলা হচ্ছে৷ কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে ক্রিকেট খেলা যায় না৷ ক্রিকেট খেলতে অনেক জিনিসপত্র লাগে৷ বল লাগে, স্টাম্প লাগে, ব্যাট লাগে আরও অনেক কিছু লাগে৷ একটু খরচের ব্যাপারও আছে৷ ফুটবল কিন্তু কোনো কিছু দিয়ে বানিয়েও খেলা যায়৷ ফুটবলের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে৷ ফলে ফুটবলে গোটা বাংলাদেশ উন্মাদ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটছে৷ হিংস্রতা বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির মধ্যে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিন্তু উন্মাদনাকে আমি খারাপভাবে দেখছি না৷ কাউকে মেরে ফেলার যে ঘটনা ঘটছে সেটা অবশ্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়৷