কেন বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন চাওয়া হচ্ছে?
৪ নভেম্বর ২০২০দন্ডবিধির ৩৭৫ ও ৩৭৬ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯(১) ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছে চারটি মানবাধিকার সংগঠন৷ হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মুজিবর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল বেঞ্চ মঙ্গলবার সরকারে ওপর রুল জারি করেছে৷ রুলে নারী ও ১৩ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের ‘বৈবাহিক ধর্ষণ' অনুমোদন দেয়ার আইনি বিধান বাতিলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে৷
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক না হলে আইনে বিয়েতে বাধা থাকলেও যদি বিয়ে হয়ে যায় তাহলে যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত তাদের শাস্তি হবে৷ কিন্তু বিয়ে অবৈধ হবে না৷ তবে বৈধভাবে বিয়ের জন্য নারীর ১৮ এবং পুরুষের ২১ বছর পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন৷
কিন্তু বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা বলছে, যদি কোনো বিবাহিত মেয়ের বয়স ১৩ বছরের কম না হয় তাহলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর যৌনসঙ্গম ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না৷
আবার দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারী বা মেয়েকে যদি তার স্বামী ধর্ষণ করেন, আর ওই নারী বা মেয়ের বয়স যদি ১২ বছরের কম হয় তাহলে স্বামীর শাস্তি হবে৷ আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার ব্যাখ্যায় বৈবাহিক ধর্ষণ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি৷
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর পক্ষে এই রিটে আদালতে শুনানি করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা পুরো আইন চ্যালেঞ্জ করিনি, আংশিক করেছি৷ ১৩ বছরের বেশি বয়স না হলে ধর্ষণ হবেনা এটা বৈষম্যমূলক আইন৷ আর ধর্ষণে বিবাহিত-অবিবাহিত এই পার্থক্য করা চলেনা৷ বয়স যাই হোক স্বামী তার স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করলে সেটা ধর্ষণ হবে না কেন? আমরা তাই আইনের সংশোধন চেয়েছি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘দেশে বাল্য বিয়ে নিরোধের আইন আছে৷ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ আইনেও যৌন নির্যাতন অপরাধ হিসেবে গণ্য৷ তবে এই দুই আইনে সমস্যা আছে৷ দণ্ডবিধিতে বলা হয়েছে, ১৩ বছরের কম না হলে ধর্ষণ হবে না৷ আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা হয়েছে, ১৬ বছরের বেশি হলে ধর্ষণ হবে না৷ এই আইন দু'টিতে সমস্যা আছে৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ব্যাখ্যাও অস্পষ্ট৷’’
রিটে বলা হয়েছে আইনের এই ব্যতিক্রমগুলো সংবিধানের ২৭, ২৮ , ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি৷ রিটের পক্ষে আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘সংবিধানের এই অনুচ্ছেদগুলোতে নাগরিকদের আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও আশ্রয় লাভের অধিকার, বৈষম্যহীনতা, আইনের আশ্রয় লাভের সমান অধিকার এবং জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না হওয়ার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু ধর্ষণ বিরোধী আইনগুলোতে বৈষম্য করা হয়েছে, যা সংবিধান পরিপন্থি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছরের বেশি হলে ধর্ষণ হবেনা এটা স্পষ্টই একটা বৈষম্য৷ আর ধর্ষণ, ধর্ষণই৷ সেটা স্বামী তার স্ত্রীকে করলেও৷ একজন বিবাহিত নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কেনো দাম থাকবেনা? তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করা হবেনা৷ এটা কীভাবে সম্ভব?’’
তিনি বলেন, এখনো সেই ঔপনিবেশিক আইন চলছে এখানে৷ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আগেই এই আইন সংশোধন করেছে৷ তারা বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে৷ আর এখানে কোনো পরিবর্তন নাই৷
বাংলাদেশের বৈবাহিক ধর্ষণের পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে রিটে৷ বিবিএস-এর জরিপ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শতকরা ২৭ ভাগ বিবহিত নারী বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার৷
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তির আওতায় আনার মত পরিবেশ বাংলাদেশে এখনো হয়নি৷ এই ধরনের আইন মানবাধিকারের প্রশ্নে হয়তো জরুরি কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে৷ এটা করার আগে বাংলাদেশে নারীদের আর্থিক এবং পেশাগত সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে৷ তা না হলে পুরুষ যদি ওই আইনের ভয়ে বিয়ে করতে নিরুৎসাহিত হয় তাহলে আরেকটি সংকট তৈরি হতে পারে৷ কারণ বাংলাদেশে এখনো বিবাহিত নারীদের বড় একটি অংশ আর্থিকভাবে স্বামীরও ওপর নির্ভরশীল৷’’
তার মতে, ১৩ বছর নয়, স্ত্রীর বয়স ১৬ বছরের বেশি হলে ধর্ষণ হবে না৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন একটি বিশেষ আইন৷ অন্য আইনের ওপর এটা প্রাধান্য পাবে৷
প্রসঙ্গত, গত মাসে টাঙ্গাইলের ১৪ বছরের এক কিশোরী বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়ে বিয়ের ৩৪ দিনের মাথায় মারা যান৷ প্রচুর রক্ত ক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়৷ প্রবাস ফেরত এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল৷ এই ঘটনায় অবশ্য থানায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা হয়েছে৷ এই ঘটনাকে রিটে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷