কার্বন নির্গমন ছাড়াও পরমাণু শক্তির ঝুঁকি কম নয়
২ মার্চ ২০২২ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ দশ বছর পরেও পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পর্কে মনোভাবের উপর সেই বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ছে৷ পরমাণু বিদ্যুৎ বিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে অঁদ্রে জাক বিপর্যয়ের পর জাপান গিয়েছিলেন৷ ফুকুশিমা তাঁকে এ বিষয়ে সক্রিয় করে তুলেছিল৷ নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অঁদ্রে বলেন, ‘‘আমার কাছে মনে হয়েছিল, পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে৷ সেই মুহূর্ত থেকে নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, পরমাণু স্থাপনার কাছে থাকার ঝুঁকি কতটা বেশি! বিশেষ করে নারী ও শিশুদের কী হবে? সম্ভাব্য দুর্ঘটনার বিপদের মাত্রা কী?''
ঘটনা হলো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির তুলনায় পরমাণু জ্বালানি অনেক বেশি বিপজ্জনক৷ কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও ঠিক যে, কয়লা ও গ্যাসের মতো জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তুলনায় মৃতের সংখ্যা অনেক কম৷ তা সত্ত্বেও জার্মানি পরমাণু বিদ্যুৎ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর বলেছিলেন, ‘‘পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রবক্তা হিসেবেও আমি স্পষ্ট বলতে চাই, যে জাপানের ঘটনার পর পরমাণু শক্তি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিকোণ বদলে গেছে৷''
জার্মানি পরমাণু শক্তি ত্যাগ করায় গোটা বিশ্বে বিস্ময় দেখা দিয়েছিল৷ কারণ জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা করতে যত দ্রুত এবং যত বেশি সম্ভব কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বন্ধ করতে হবে৷ পরমাণু বিদ্যুতের জোগান ছাড়া সেই অসাধ্যসাধন করা আরও কঠিন৷ বিশ্ব পরমাণু সংঘের সামা বিলবাও ই লেয়ন বলেন, ‘‘আমাদের সামনে জরুরি ও বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ সত্যি, না বলার বিলাসিতা আমাদের নেই৷''
পরমাণু বিদ্যুৎ ত্যাগ করার ফলে একটা সুবিধাও দেখা গেছে৷ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার আরও বড় আকারে সম্ভব হচ্ছে৷ গত দশ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এমন উৎসের অনুপাত ২০ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশ ছুঁয়েছে৷ আগোরা ক্লিন এনার্জি ট্রানজিশন কোম্পানির মুরিয়েল গানিয়েব্যাঁ মনে করেন, ‘‘দুই পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে৷ জার্মানি হয়তো আরও দ্রুত এবং কিছুটা অন্য ভাবে নির্গমন কমাতে পারতো৷ কিন্তু অন্যদিকে এর ফলে শুধু জার্মানি নয়, বিশ্বব্যাপী রিনিউয়েবলের ব্যবহার আরও বাড়ছে৷''
জার্মানির প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্স একেবারে ভিন্ন পথ নিচ্ছে৷ সে দেশে ৫০টিরও বেশি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে৷ কিন্তু সমস্যা হলো, অনেকগুলি কেন্দ্রই অত্যন্ত পুরানো৷ পরমাণু বিদ্যুৎ বিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট অঁদ্রে জাক বলেন, ‘‘পরমাণু কেন্দ্র যত পুরানো হয়, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও তত বেড়ে যায়৷ সেগুলির নিখুঁত ক্রিয়ার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না৷ মনে রাখতে হবে, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তীব্র বিকিরণযুক্ত পদার্থ উৎপাদিত হয়৷''
যেমন ৫০ বছরেরও বেশি পুরানো ‘লা আগ' রিসাইক্লিং প্লান্ট৷ তবে গবেষকদের মতে, বিশাল এই কেন্দ্রের কোনো ভবিষ্যৎ নেই৷ ভবিষ্যতের পরমাণু শক্তি একেবারে অন্যরকম হতে হবে৷ কৌশলগত গবেষণা ফাউন্ডেশনের নিকোলা মাসুকি মনে করেন, ‘‘কারখানায় বড় আকারে তৈরি করা যায়, এমন চুল্লি সৃষ্টির আইডিয়া এখন গুরুত্ব পাচ্ছে৷ সে ক্ষেত্রে মান বজায় রেখেই ব্যয় কমানো সম্ভব হবে৷''
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অনেকেই পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভর করছে৷ বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে অনেক নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে৷ সমালোচকরা মোটেই সন্তুষ্ট নন৷ তাঁদের মতে, পরমাণু শক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সবসময়ে রাজনৈতিক স্তরে নেওয়া হয়৷ কারণ পরমাণু বিদ্যুতের ব্যয় বিকল্প জ্বালানির তুলনায় অনেক বেশি৷ ফলে করদাতাদের জন্য সেটি মোটেই আকর্ষণীয় নয় বলে তাঁরা মনে করেন৷
বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টিয়ান ফন হিয়র্শহাউসেন বলেন, ‘‘যেখানেই জ্বালানির অর্থনৈতিক মাপকাঠি বিচার করা হয়, সেখানে পরমাণু শক্তির কোনো ভূমিকা থাকে না৷ পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ফ্রান্সে এই উৎস অর্থনৈতিক বিপর্যয় ছাড়া কিছুই নয়৷ ইডিএফ ও ফ্রান্সের বিদ্যুৎ কোম্পানিকে সেই কর্মসূচির বোঝা টানতে হয়৷ তাদের ঋণের অঙ্ক চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি৷ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এনে সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করার প্রক্রিয়া চলছে৷''
মোটকথা, বিষয়টি বিতর্কিত থেকে যাচ্ছে৷ কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমাতে চাইলেও আমাদের জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে৷ সে ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে প্রত্যেক দেশকে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷
স্ট্রাউস/নীরঞ্জন/এসবি