‘বাংলাদেশের অন্য সিনেমা’
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩
বইয়ের নাম ‘বাংলাদেশের অন্য সিনেমা’৷ মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির বাইরেও সমান্তরাল সিনেমার যে চর্চা হয়ে আসছে গত তিন দশক ধরে, তারই ইতিহাস সম্পাদনা করেছেন শ্রী সুশীল সাহা৷ কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স সদ্য প্রকাশ করল ছটি খণ্ডে বাংলাদেশের সমান্তরাল সিনেমার এই ইতিহাস৷ সম্প্রতি কলকাতার রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গোর্কি সদনে, আইজেনস্টাইন সিনে ক্লাবের সঙ্গে অভিযানের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হল৷
বাংলাদেশের সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রকার তানভির মোকাম্মেল এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন যে, অজানা থেকেই আসে অজ্ঞানতা৷ বাংলাদেশেও যে ভাল ছবি তৈরি হয়, সেটাই অনেকে জানেন না৷ এমনকি বাংলাদেশের মানুষদের অনেকেই খবর রাখেন না৷ বাংলাদেশের অন্য সিনেমা বইটির সম্পাদক সুশীল সাহা যদিও মনে করেন, এর জন্য সংবাদমাধ্যমের ভুল প্রচার অনেকটাই দায়ী৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমই বুদ্ধিহীন নাচ-গান-মারামারি এবং অতি নাটকীয়তায় জারিত বাংলা ছবিগুলোর কথা এমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে, যেন তার বাইরে অন্য ধারার বাংলা ছবি তৈরিই হয় না বাংলাদেশে৷ আর দেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ, যাঁরা ভাল সাহিত্য বা ভাল ছবির সমঝদার, তারা নিজেদের দেশের ছবির কথা উঠলে লজ্জায় অধোবদন হয়ে থাকেন৷
যারা বাংলাদেশে ছবি তৈরির জন্য অর্থ লগ্নি করেন, সেই প্রযোজকদেরও এই পরিস্থিতির জন্য সমান দায়ী করেন সুশীল সাহা, যেহেতু ওঁদের উৎসাহেই হিন্দি অথবা তামিল ছবির অক্ষম অনুকরণ হয় বাংলা ছবিতে৷ সে সব ছবি এক সপ্তাহ বা দু সপ্তাহও যদি বাজারে চলে, তা হলেও লগ্নি করা টাকা উঠে আসে৷ অন্য ধারার ছবির ক্ষেত্রে সেই দর্শকানুকূল্য পাওয়া সম্ভব নয়৷ অন্যদিকে আছেন ছবির ডিস্ট্রিবিউটররা, যাঁরা ঠিক করেন কোন ছবি কোন প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হবে এবং কদিন দেখানো হবে৷ এরাও একটা মোটা অঙ্কের অর্থ ডিস্ট্রিবিউশন ফি হিসেবে নেন, যেটা স্বাধীন চিত্র পরিচালক বা সীমিত ক্ষমতার প্রযোজকদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না৷
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতেই বাংলাদেশের কিছু নবীন পরিচালক একটা সমান্তরাল চলচ্চিত্র সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন, যেখানে ছবি দেখানো হবে একক বা যৌথ উদ্যোগে কোনও একটা হলঘর ভাড়া করে, হয়তো ছোট পর্দায় এবং প্রেক্ষাগৃহের থেকে অনেক কম খরচে৷ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা এই চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করলো, পৃষ্ঠপোষকতা জোগাল৷ সেই সমান্তরাল চলচ্চিত্র আন্দোলন থেকেই উঠে এলেন তারেক মাসুদ, তানভির মোকাম্মেল বা মোর্শেদুল ইসলামের মতো পরিচালকেরা৷ প্রয়াত তারেক মাসুদের বিখ্যাত ছবি ‘মাটির ময়না’-ই ছিল এ ব্যাপারে মোড় ঘোরানো, নয়া নজির তৈরি করা একটি ছবি, যা আরও বহু নবীন চিত্র পরিচালককে উদ্দীপিত করেছিল৷
সুশীল সাহা তাঁর বইতে এই পরিচালকত্রয়ীর কথাই মূলত লিখেছেন, যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মোড় ঘুরিয়েছেন৷ এবং ‘লাল সালু’, বা ‘তিস্তা নদীর পারে’ অথবা ‘আমার বন্ধু রাসেল’ – এর মতো যে সব অসামান্য ছবি একে একে তৈরি হয়েছে, তার কথাও লিখেছেন৷ রয়েছে ছবিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক রিভিউ, সংশ্লিষ্টজনের সাক্ষাৎকার, পুরনো চিঠিপত্র ইত্যাদি যা যা দরকার ইতিহাসের পুনর্নির্মাণে৷ সেই সঙ্গে যে নবীন পরিচালকরা হাত মিলিয়েছেন এই সমান্তরাল সিনেমার ধারাটিকে উজ্জীবিত রাখতে, তাঁদের এবং তাঁদের সিনেমা সম্পর্কিত তথ্যও রয়েছে৷
বাংলাদেশের অন্য ধারার সিনেমা নিয়ে এ ধরনের বই পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত এই প্রথম৷ প্রকাশক সংস্থা অভিযান পাবলিশার্স-এর কর্ণধার মারুফ হোসেন জানালেন, বাংলাদেশেও সম্ভবত এমন বই এখন আর নেই৷ আগে একটি বই পাওয়া যেত, যেটি এখন আউট অফ প্রিন্ট৷ গত বইমেলায় অভিযান পাবলিশার্স বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্প বলে একটি বই প্রকাশ করেছিল, যে বইটি পাঠক মহলে খুবই সমাদৃত হয়েছিল৷ এই নতুন বইটিও একই রকম সাড়া ফেলবে বলে মারুফ হোসেনের বিশ্বাস৷
আর সুশীল সাহার গোপন একটি দুঃখ আছে৷ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বা ‘বাবা কেন চাকর’ গোত্রের ছবি বাংলাদেশ থেকে টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সত্যিকারের যে ভাল ছবি, তা কখনও কলকাতার কোনও প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে রিলিজ করে না৷ কারণ, মানুষ জানে না, খবর রাখে না৷ ‘বাংলাদেশের অন্য সিনেমা’ বইটি প্রকাশের সময় একেবারেই ঠিক কথা বলেছেন তানভির মোকাম্মেল যে, না জানাটাই অজ্ঞানতা তৈরি করে৷