করোনায় বাল্যবিয়ে: স্কুলছাত্রীদের ঝরে পড়া বেড়েছে!
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১বাল্যবিয়ের কারণে কী পরিমাণ স্কুলছাত্রী ঝরে পড়েছে সে সংখ্যা জানা না গেলেও কিছু বেসরকারি সংস্থা বলছে করোনার সময়ে দেশজুড়েই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ের ঘটনা৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা বলছে, দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে৷ গত ২৫ বছরে যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ৷
এদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ৷ আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ৷ তবে করোনায় এ সংখ্যা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছে সরকার৷ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও আগামী শিক্ষাবর্ষে ৭৭ লাখ বই কম ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে মোট ছাত্রী ৪৭০ জন৷ তাদের মধ্যে ৬৭ জনেরই চলতি বছর বিয়ে হয়ে গেছে৷ যাদের বিয়ে হয়েছে তারা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক৷ সাতক্ষীরা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির প্রধান সাকিবুর রহমান সরেজমিন গিয়ে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন৷
যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের সর্বোচ্চ বয়স ১৭ বছর৷ আর তাদের বেশির ভাগের বয়সই ১৬ বছর৷ তারা সবাই নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী৷ তবে ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিয়ের ঘটনাও ঘটেছে৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে সাকিবুর রহমান বলেন, ‘‘করোনার সময়ে প্রধানত খরচ মেটাতে না পেরেই বাল্যবিয়ের এমন ঘটনা ঘটেছে৷ বিশেষ করে অনলাইন ক্লাসের জন্য ইন্টারনেট ডাটা কেনা তাদের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ আর অভিভাবকদের আয়ও কমে যায়৷''
তিনি জানান, বিয়ে হওয়া এ ছাত্রীদের কেউই আর স্কুলে যাচ্ছে না৷ তিনি আরো দাবি করেন, স্কুল থেকেও বিবাহিত মেয়েদের স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছে৷ কারণ তারা মনে করছেন, ওই মেয়েরা স্কুলে গিয়ে বিয়ের গল্প করলে অন্য মেয়েরাও বিয়েতে উৎসাহিত হতে পারে৷ আর যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই কাবিন নেই৷ ফলে বয়স নিয়ে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি৷
শনিবার তালা উপজেলার শার্শা বাহারুল উলুম মাদ্রাসায় ঘুরে সাকিবুর রহমান জানান ওই মাদ্রাসায় মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৬৯ জন৷ এর মধ্যে মোট ছাত্রী ৮৭ জন৷ ছাত্রীদের ৪০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে৷ দশম শ্রেণীর ১৮ জন ছাত্রীর মধ্যে ১১ জনের এবং অষ্টম শ্রেণীর ১৮ জনের মধ্যে আট জনের বিয়ে হয়েছে৷ যাদের বিয়ে হয়েছে তারা আর মাদ্রাসায় আসছে না৷
আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফ ছাত্রীদের বাল্যবিয়ের কথা স্বীকার করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এবার ৬৮ জনের এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু পরীক্ষা দেবে ৪৭ জন৷ ২১ জন দিচ্ছে না৷ তাদের বিয়ে হয়ে গেছে৷ দশম শ্রেণীর ১৪-১৫ জনের বিয়ে হয়ে গেছে৷ আরও চার-পাঁচ জন আছে বিয়ে হয়েছে৷ তারা নিচের ক্লাসে পড়ে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘যাদের বিয়ে হয়েছে তারা যাতে স্কুলে আসে তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ শিক্ষকদের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যাতে বাল্যবিয়ের ঘটনা না ঘটে৷’’
এদিকে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে৷ সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহের তথ্য পেয়েছে তারা৷
গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট ২১ জেলায় জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটি৷
প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাস বলেন, ‘‘এই বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে আমরা যা জেনেছি তার মধ্যে রয়েছে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিরাপত্তা সংকট, অভিভাবকদের কাজ হারানো এবং ব্যবসা-বণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া৷ তাছাড়া বাল্যবিয়ের যেহেতু একটি ট্রেডিশন আছে তাই করোনাকে বিয়ে দেয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন অনেকে৷’’
তিনি জানান, যারা এই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তারা সবাই স্কুলের ছাত্রী৷ আর বিয়েগুলো হয়েছে শুক্র-শনিবার বন্ধের দিন-রাতে৷ তার মতে, ‘‘তারা (বিয়ে হয়ে যাওয়া এসব ছাত্রী) সবাই শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে৷ আমরা এখন যে খবর পাচ্ছি তাতে ড্রপআউটের তথ্য পাচ্ছি৷ আমরা সে কারণে আরেকটি জরিপ করবো৷’’
তিনি বলেন, করোনার সময় বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের কারণে ঠিক কি পরিমাণ ছাত্রী ঝরে পড়েছে তা এখনই বলা যাচ্ছেনা৷ কারণ এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ হয়নি৷
মেয়েদের ড্রপআউট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলাদাভাবে কাজ না হলেও করোনাকালে ড্রপআউট শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি৷
অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিতি ধরে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ওই তালিকা করা হয়৷ মংলা উপজেলা শিক্ষা অফিসার (প্রাথমিক) সুমন্ত পোদ্দার দুই সপ্তাহ আগে জানান, ‘‘আমাদের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তাতে প্রাথমিকে শতকরা ৫০ ভাগের মত ড্রপ আউট দেখানো হয়েছে৷ এখন আমরা এটা সরেজমিন পরীক্ষা করে দেখছি৷ কাজ শেষ করতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে৷’’
দেশের ৬৪ জেলার ৩৪৫টি উপজেলা, সব সিটি কর্পোরেশন এবং ১৫টি শহরে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে৷
এদিকে সারাদেশে বাংলা মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল ৪০ হাজার৷ করোনার কারণে এই ধরনের ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে৷ এ স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের শতকরা ৫২ ভাগ মেয়ে বলে জানান বাংলাদেশ কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জিএম জাহাঙ্গীর কবির রানা৷
তিনি বলেন, ‘‘বন্ধ হয়ে যাওয়া ১০ হাজার স্কুলের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অন্য কোথাও ভর্তি হয়নি৷ আর সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী স্কুলে ফিরেছে৷’’