1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কতদিন করব অস্বীকার?

১ মে ২০১৮

শ্রমঘন বাংলাদেশে শ্রমিকরা কতটা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন তার প্রমাণ তাজরীন ফ্যাশনস বা রানা প্লাজার ঘটনা৷ ঝুঁকি যতটা শারীরিক, ততটাই মানসিক৷ প্রান্তিক এই মানুষগুলোর অনেককেই আমি দেখেছি মানসিক পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে৷

https://p.dw.com/p/2wqQG
Bangladesch Textilfabrik Jahrestag Rana
ছবি: DW/M. Mamun

২০১৬ সাল৷ তিন বছর পূরণ হলো রানা প্লাজা দুর্ঘটনার৷ এর মধ্যে দেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে অনেক পরিবর্তন এলো৷ অনেক পোশাক কারখানাই তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করল৷ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটল অনেক কারখানায়৷ এখন তো বিশ্বজুড়ে সবুজ কারখানার তালিকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশের বেশ ক'টি পোশাক কারখানা৷

সে যা-ই হোক, সেবার রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকারদের মানসিক অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলাম সাভারে৷ কথা বললাম বেশ ক'জনের সঙ্গে৷ তাঁদের একজন শাহজাহান সেলিম৷ যাঁরা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার খোঁজ খবর রেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই পরিচিত এই নামটির সঙ্গে৷ সাভারে একটি বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকেন শাহজাহান৷

ক্রাচে ভর করে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তিনি৷ মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি৷ যে ঘরে আমরা বসেছি, তাতে একটি খাট আর একটা আলমারি৷ জানলার ওপারে একটু বারান্দাও আছে৷

তিনি একটি গান শোনান আমাদের৷ গানটি লিখেছেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে৷ জানালা দিয়ে দুপুরের রোদ পড়ছে শাহজাহানের ভিজে ওঠা চোখে৷ ভ্রুক্ষেপ নেই৷ গেয়ে চলেছেন তিনি৷ ‘‘আমি কী যে ভুল করেছি, রানা প্লাজায় গিয়েছি৷ এখন শুধু ঝরা মালা গাঁথি৷ সারাটি জীবন দুঃখ হলো মোর সাথি৷''

শাহজাহান সরাসরি দুর্ঘটনার শিকার নন৷ তিনি ছিলেন উদ্ধারকারী৷ বহু আহতকে উদ্ধার করেছেন তিনি৷ উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই আহত হন৷ হয়ে যান পঙ্গু৷

‘‘আলতাফ আমার কাছে পানি চাইছিল৷ আমি পানি দিছিলাম৷ কিন্তু সে পানি খাইতে পারে নাই৷ এসব কথা যখন মনে হয়, তখন নিজেকে স্থির রাখতে পারি না৷''

প্রতিনিয়ত সেসব ঘটনা তাড়া করে ফেরে শাহজাহানকে৷ অনেককে হাত-পা কেটে জীবিত বা মৃত অবস্থায় বের করে এনেছিলেন৷ সেই আর্তচিৎকার, সেই রক্তাক্ত ঘটনাগুলো কেড়ে নিয়েছে তাঁর ঘুম৷

‘‘এমনিতে ঘুম হয় না৷ যদিও একটু চোখ লাগে, তখন অল্প শব্দেই লাফ দিয়া উঠি৷''

আরো অনেক কথা বললেন শাহজাহান৷ ভারাক্রান্ত মনে যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন ডেকে বললেন, ‘‘কারখানায় মানুষগুলা অনেক কষ্ট করে কাজ করেন৷ আপনারা তাঁদের কথা বলবেন৷ আমার মতো বা আমার চেয়েও অনেকে খারাপ অবস্থায় আছে৷''

গনগনে সূর্যটা তখন সবেমাত্র পশ্চিম দিকে হেলেছে৷ আমার কেন যেন খুব পানির পিপাসা পাচ্ছিল৷ ছুটে চললাম একটি এনজিও'র মানসিক পরিচর্যা কার্যক্রম দেখতে৷

সেখানে গিয়ে কথা হলো রুপা, নিলুফা, খালেদা ও আসমার সঙ্গে৷ এঁরা প্রত্যেকেই পোশাক শ্রমিক৷ দুর্ঘটনার সময়ে রানা প্লাজার ভেতরেই ছিলেন৷ তবে শারীরিকভাবে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি তাঁদের৷ কিন্তু এঁরা কেউই এখন আর কাজ করতে পারেন না৷ প্রচণ্ড ভয়, দুর্বিষহ সব স্মৃতি সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায় তাঁদের৷

কাঁদতে কাঁদতে আসমা বলছিলেন, ‘‘এমন কইরা বাইচা থাকার চাইতে সেই সময় মইরা গেলেই ভালো হইতো৷''

কাজ করেন না৷ তাই বাড়ির সবার ‘খোটা' সহ্য করেও কোনোমতে টিকে আছেন খালেদা৷ বলেন, ‘‘আমি তো চাই কাজ করতে৷ কিন্তু পারি না৷ যতবার যাই, মনে হয়, এই বুঝি বিল্ডিং কাইপা উঠল৷ চইলা আসি৷ ঘুমাইতে পারি না৷ যারা মারা গেছে, লাশগুলা ডাকে৷''

এঁরা সবাই তাঁদের আত্মীয়-অনাত্মীয় সহকর্মী হারিয়েছেন রানা প্লাজার দুর্ঘটনায়৷ নিলুফা তাঁর বাসার পাশে একটি রাস্তায় একটু ফাটল ধরেছে বলে সেই রাস্তা দিয়ে কখনো যান না৷ কারণ, তাঁর মনে হয়, সেই রাস্তায় তিনি ডেবে যাবেন৷

‘‘পরশু দিন মাচা থিক্কা একটা পাতিল পড়ছে আমার গায়ে৷ ভয়ে আমার দাঁতে দাঁত লাইগা গেছে গা৷'' বলছিলেন তিনি৷

Zobaer Ahmed
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলেছবি: Zobaer Ahmed

কথা হলো, এনজিওটির দুই মনোসামাজিক পরামর্শকের সঙ্গে৷ তাঁরা জানালেন যে, একে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি বলে৷ এই সমস্যায় ঠিকমতো মানসিক চিকিৎসা না দিলে এই মানসিক পঙ্গুত্ব থেকে এদের মুক্তি সহসা মিলবে না৷

একই বিষয় নিয়ে পরদিন কথা বলতে গেলাম জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারুক আলমের সঙ্গে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আর্থিক অনুদানে একটি প্রকল্পের অধীনে তিনি ও তাঁর দল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকারদের অনেককেই শুরুর দিকে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়েছেন৷ তিনি যা বললেন, তা আরো ভয়াবহ৷

‘‘আমাদের এখানে এক রোগী ছিলেন৷ উনি একজন উদ্ধারকারী৷ কিন্তু পরে নিজেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ আমরা প্রায়ই দেখতাম, হাসপাতালের বিছানার নীচ থেকে তিনি লাশ উদ্ধার করার চেষ্টা করতেন৷''

তিনি বলেন যে, বেশ কয়েকজন এমনই বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন যে, আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত চলে যায়৷ পিটিএসডি ও বিষণ্ণতাসহ বেশ কয়েকটি মানসিক রোগে আক্রান্ত দুর্ঘটনার শিকাররা৷ কিন্তু অর্থের অভাবে তাঁদের ঠিকমতো পরিচর্যা দেয়া হয়নি৷ সরকারি ও বিদেশি কিছু সাহায্য মিলে তাৎক্ষণিকভাবে যে সেবা দেয়া হয়েছে, তা যথার্থ নয়৷

তিনি স্বীকার করলেন যে, যে দেশে দু'মুঠো খাদ্য জোগাড় করাই দুঃসাধ্য, সেখানে শারীরিক স্বাস্থ্যের পর মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা বিলাসিতাই মনে হতে পারে৷

কিন্তু এই বিলাসিতা যে প্রয়োজনের নামান্তর, সেই মানসিকতা তৈরি করতে হবে৷ কারণ, এতগুলো মানুষ, যাঁরা মানসিক পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাঁদের শ্রমহীনতা শুধু সেই মানুষটিরই ক্ষতি করছে তাই নয়, তাঁদের পরিবার ও সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে৷

আর কিছু ক্ষতি চোখে দেখা যায় না৷ তাই আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে৷

আপনি কি মনে করেন, এঁদের মানসিক সুরক্ষা দেয়া সরকারের দায়িত্ব?