এলেবেলে নয় মোটেই
১৪ ডিসেম্বর ২০২০আপনারা জানতেন কি, ঝিঁঝিপোকার ডাক থেকে বাইরের তাপমাত্রা বলে দেওয়া সম্ভব? ১৪ সেকেন্ডের মধ্যে ঝিঁঝিপোকা যতবার ডাকে, তার সঙ্গে ৪০ যোগ করলেই পাওয়া যাবে ডিগ্রি ফারেনহাইটে বাইরের তাপমাত্রা৷ অথবা, এক ঘন ইঞ্চি মানুষের হাড় ৮৬২৬ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে, যা পাঁচটা ট্রাকের ওজনের সমান৷ যার থেকে প্রমাণ হয়, মানুষের হাড় কংক্রিটের থেকেও বেশি শক্তিশালী৷ জানতেন?
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের চর্চা বাড়াতে, বিজ্ঞানকে সাধারণের মধ্যে আরও সহজবোধ্য এবং জনপ্রিয় করে তুলতে প্রকৃতির এমন বিচিত্র সব তথ্য খুঁজে নিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে সদ্যোজাত একটি ওয়েবসাইট, যার ঠিকানা এলেবেলে ডট ওআরজি৷ ওদের আছে ফেসবুক পেজ, যেখানে ‘তাই নাকি!' বিভাগে নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে আগ্রহজনক সব তথ্য৷ সদ্য চালু হয়েছে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল, যেখানে নানা বিজ্ঞাননির্ভর বিষয়ের ভিডিও আপলোড করা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু মূলত যেটা করছে এলেবেলে, তা হলো বাংলা ভাষায় এবং সহজে বোঝা যায়, এমনভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থাপনা৷ এবং সেটাও অনেক সময়ই মজাদার গল্প এবং সংলাপের মধ্যে দিয়ে৷ যেমন ধরা যাক, এ বছর পদার্থবিদ্যায় যে তিনজন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তাঁদের গবেষণার বিষয়গুলো কী, তা যেমন বোঝানো হচ্ছে, তেমনই মজাদার সংলাপের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে, প্রচণ্ড শীতে জলের ওপরের তল জমে বরফ হয়ে গেলেও, তার নিচে মাছ ও অন্যান্য জলচর প্রাণি কীভাবে বেঁচে থাকে৷ আমাদের নিত্য ব্যবহার্য স্মার্টফোনের স্ক্রিন কীভাবে কাজ করে, তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পৌঁছে যাওয়া হচ্ছে জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত মৌল ‘ইন্ডিয়াম'–এর কাছে, যে নামের সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে নীল চাষের সংযোগ আছে৷
এলেবেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই, কিন্তু মূল কারিগর ওরা আটজন৷ উৎস সবারই কলকাতায়, কিন্তু এখন ছড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায়৷ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানফোর্ড বার্নহ্যাম ইনস্টিটিউটে গবেষক নির্মাল্য দাশগুপ্ত, শিবপুরের আই আইইএসটি'র গবেষক অর্কব্রত গুপ্ত, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অর্চিষ্মান মহাপাত্র, সুইৎসারল্যান্ডের পল সেহরার ইনস্টিটিউটের গবেষক প্রত্যয় ঘোষ, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক চিরশ্রী লাহিড়ী, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ছাত্রী দিশানী লক্ষণ, দিল্লির জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মেঘদীপা অধিকারী, ভারতের মৌসম বিভাগের কর্মী সোমাশ্রী মন্ডল এবং শিবপুরের বৈদ্যুতিক প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র স্বর্ণাভ চক্রবর্তী৷ মজার কথা হচ্ছে, এরা অনেকেই পরস্পরকে চিনতেন না৷ কোভিড লক ডাউনের সময় সোশাল মিডিয়ায় পোস্টের সূত্র ধরে তাদের আলাপ৷ চিন্তাগত অবস্থান থেকে এক জায়গায় নিজেদের খুঁজে পাওয়ার পরই বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট তৈরির ভাবনা, যে সাইট প্রথম থেকেই উৎসাহীদের আকৃষ্ট করছে৷
সবার পক্ষ থেকে অর্কব্রত গুপ্ত বললেন, ‘‘আশপাশের মানুষজনের কথা যদি বলি, তাদের অনেকেই অন্ধ সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে থাকেন৷ সর্বোপরি অনেক সাধারণ জিনিস জানতে পারেন না৷ সূর্যগ্রহণ বলুন, বা অন্য আরও ঘটনা রয়েছে, যেগুলো সম্বন্ধে জানার সুযোগ তাদের নেই৷ আর জানতে গেলে তাদের তো পড়তে হবে৷ কীভাবে পড়বেন? পড়ার মেটেরিয়াল তো নেই, তাও আবার বাংলায়৷ আমার উদ্দেশ্য ছিল সেটাই, যে আমার আশপাশে যে লোকগুলো রয়েছে... আমি নিজে শিক্ষিত হলেই তো হল না, আমি যদি তাদেরও (শিক্ষিত করতে না পারি), আমার মনে হয় পুরোটাই ব্যর্থ৷''
অর্কব্রত জানিয়েছেন, বাংলায় বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা নিয়মিত প্রকাশের পাশাপাশি বিজ্ঞানের পরিভাষার একটি অনলাইন শব্দকোষ তৈরিতেও ওরা উদ্যোগী হয়েছেন৷ বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষারও প্রচলন হয়েছিল, যা অব্যবহারে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেই শব্দগুলোর পুনরুদ্ধারেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ আর একই সঙ্গে আরও একটা কাজ করছেন ওরা৷ ভুল বিজ্ঞান, বা অপবিজ্ঞানের প্রসার আটকাতে যুক্তি দিয়ে, তত্ত্ব আর তথ্য দিয়ে একটা পাল্টা বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন, যা বিরোধের থেকেই বেশি জোর দেবে মীমাংসায়৷ তর্ক করে কারও চিন্তাভাবনা বদলে ফেলা যায় না, বোঝালেবরং বেশি কাজ হয়৷ বিশ্বাস করেন ওরা৷
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়