জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন ‘হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়'৷ আজকাল বোধ হয়, তেমন হৃদয় আর নেই যেখানে বোধ জন্ম নেবে৷ বিশ্বায়নের যুগে কে আর হৃদয়ের কথা শুনিতে ব্যাকুল হবে আজ?
এ কথাগুলোই আজ বারবার ঘুরে ফিরে মনে আসছে৷ একটি বদলে যাওয়া পৃথিবীতেপ্রায় অচেনা হয়ে যাওয়া সবকিছুর দিকে এভাবে বিমূঢ় তাকিয়ে থাকাই বোধ হয় আমাদের নিয়তি হয়ে গেল৷ না হলে একজন নারী, তিনি তার পছন্দমতো সাজসজ্জা করলেন, তাতে অন্যের মাথাব্যথা হচ্ছে কেন? একজন বিজ্ঞান শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কারও অযৌক্তিক বালখিল্য মতামতের সঙ্গে সেটা মিলছে না বলেই সবাই মিলে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলো! আর এই আচরণ কিনা শুরু হলো শিক্ষার্থীদের থেকেই! এ কি কেবলই অপরাধীদের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না বলে? নাকি গোটা দেশজুড়ে একটি কূপমণ্ডুক মানসিকতার চাষাবাদ হচ্ছে আর তারই ফল আমরা ভোগ করছি?
প্রশ্নগুলো আজকের নয়৷ গোটা পৃথিবীতেই নারীর দিকে আঙুল তুলে ফেলা খুব সহজ৷ প্রচলিত ধর্ম, অনুশাসন, আইনকানুন এমনকি পৃথিবীর কোথাও কোথাও রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত নারীকেকাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷ কোথাও ফতোয়া জারি করা হচ্ছে নারীর স্বাধীন চলাফেরার উপরে, কোথাও আঘাত হানা হচ্ছে তার ব্যক্তিস্বাধীনতার সৌধটি ভেঙে ফেলার জন্যে, আবার কোথাও বা তার সাজপোষাকের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে৷ সম্প্রতি বাংলাদেশে একজন টিপ পরিহিতা নারীর সঙ্গে যে আচরণ করেছেন একজন পুলিশ সদস্য, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে আমাদের শুভবোধগুলো ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ আমাদের গন্তব্য কি শেষপর্যন্ত একটি গভীর অন্ধকার সরণিতে গিয়ে মিলিয়ে যাবে?
কেবল লতা সমাদ্দারের টিপ পরার ওপর কনস্টেবল নাজমুলের অন্যায় চড়াও হবার ঘটনাটিই নয়, এমন অসংখ্য লতা সমাদ্দারকে প্রতিদিন মহানগরের পথে-ঘাটে এমন আচরণের শিকার হতে হয়৷ আর কনস্টেবল নাজমুল বা তার মতো মানসিকতার হাজার হাজার পুরুষকে দেখতে হয় প্রতিদিন চলার পথে কিংবা সাইবার জগতে৷ কখনো কখনো নারীরাও যোগ দেয় এই দলে৷
এই তো কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি বাসে একজন নারীর পোশাক নিয়ে অন্য একজন নারী যা তা বলে গেলেন লোকসম্মুখে৷ বাসের যাত্রীদের কেউ তেমন প্রতিবাদ পর্যন্ত করলো না! ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে আমরা তা জানতে পারলাম বটে, কিন্তু এমন কত ঘটনা ঘটছে, যেগুলো হয়ত জানিও না৷ দু একটি ঘটনার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে, কিন্তু সে এমনই সামান্য যে আঙুল গুনে বলে দেয়া যায়৷ বাকিগুলোর কথা সময়ের সাথে ভুলে যাই আমরা, ভুলে যায় বাংলাদেশ৷ কেবল মনে থাকে সেই ভুক্তভোগী নারীর, স্বদেশের প্রতি যার সমস্ত বিশ্বাস-স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে৷
এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের পর যৌক্তিক কারণেই আমরা আইন প্রয়োগের কথা বলি৷ বলেও যে সবসময় আইনের সহায়তা আমরা পাই না, সে তো জানা কথাই৷ কিন্তু প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি প্রশ্ন এসে যায়, আইন প্রয়োগ করে অপরাধীর শাস্তির বিধান না হয় দেয়া হলো, কিন্তু ঘরে ঘরে যে নাজমুলগুলো তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে? এখানেই চলে আসে বোধ নির্মাণের বিষয়টি৷
গত কয়েক বছর ধরেই জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের জিরো টলারেন্সের কথাটি আমরা শুনে এসেছি৷ জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাফল্যও আমরা দেখেছি৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতেই কি সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? হয় যে না, তা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি৷ হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা সামাজিক কাঠামো নিয়ে বেশ কিছুদিন আলোচনা হয়েছে৷ এ বিষয়ে কিছু গবেষণাপত্র পড়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে৷ কিন্তু ওই ওটুকুই৷ এরপর এ নিয়ে তেমন কাজ হয়েছে বলে আমি জানি না৷ এ না জানাটা আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাও হতে পারে৷ এখন আমি যদি হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, লতা সমাদ্দারের ওপর ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন বা স্কুল শিক্ষার্থীদের হঠাৎ করে বিজ্ঞান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তথাকথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা ইত্যাদি ঘটনাগুলোকে একসূত্রে দাঁড় করাই, নিশ্চয়ই তা ভুল হবে না৷ কারণ আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, জঙ্গি মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে আমাদের শিশুরা৷ প্রকাশ্য দিবালোকে জঙ্গি মানসিকতার একজন পুলিশ সদস্যকে আমরা দেখছি টিপ পরা একজন নারীকে অসম্মান করে তার জীবননাশের হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে৷ ফলে জঙ্গি কেবল ঘটনাস্থলেই থাকে, তা নয়, জঙ্গি মানসিকতার বিস্তৃতি আজকাল সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে৷
প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি সময় আমি শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের আমি পেশাগত কারণেই খুব কাছ থেকে দেখি৷ এই তিন দশকে আমি কেবল কয়েকটি প্রজন্মকেই বড় হতে দেখিনি, একই সঙ্গে তাদের পারিবারিক বা সামাজিক কাঠামোর বদলগুলোও দেখেছি৷ একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ- তার নাম-ধাম-পেশা-জাতীয়তাবাদ-লিঙ্গ বা ধর্ম এসবই তার গৌণ বা ব্যবহারিক পরিচয়মাত্র৷ কিন্তু এই গৌণ পরিচয়গুলোই যখন একজন শিশুর সামনে মুখ্য করে তোলা হয়, তখনই সংকটের শুরু হয় বলে আমি মনে করি৷ একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার পরিবারে৷ পরিবারের মানসিকতা নিঃসন্দেহে তাকে বহন করতেই হবে, অন্তত একটা সময় পর্যন্ত তো অবশ্যই৷ আমি বলছি না, একজন মানুষ তার পরিবারের শিক্ষাটাই জীবনের শেষ পর্যন্ত বহন করেন; কিন্তু তার ছাপ তার মধ্যে থেকেই যায়৷ সুতরাং পরিবার যদি একজন শিশুর সামনে ধর্মের বা লিঙ্গের ভেদাভেদ করে থাকে, তবে সেটা তার মধ্যে থেকে যাবেই৷ আমি নিশ্চিত, কনস্টেবল নাজমুল বা মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকেই এ ভেদাভেদ ও কূপমণ্ডুকতা শিখে এসেছে৷ তারপর সেটা ডালপালা মেলেছে তাদের পরবর্তী জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে৷ তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও এ দোষ থেকে মুক্ত নয়৷ সেখানেও ব্যক্তিই প্রাধান্য পায়; কারণ আমি তো মনে করি না বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক বা শিক্ষার্থীই এমন ধর্মান্ধ মানসিকতার৷ আমি তো মনে করি না পুলিশের সকল সদস্যই এমন সাম্প্রদায়িক৷ ফলে বোধের যে আতুরঘর, সেই পরিবারকে একটু নড়ে বসতে হবে৷ সন্তানকে ধর্ম শেখানোর নামে ভুলসর্বস্ব ওয়াজ শুনিয়ে, ভেদাভেদ শিখিয়ে সাম্প্রদায়িকতা শিখিয়ে যে বাবা-মা ভাবছেন সন্তান ধর্মের পথে আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন৷ যুগে যুগে ধর্ম উদারনৈতিকতার বাণী ছড়িয়েছে, মানুষকে সম্মান-শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ এসব থেকে সরে গিয়ে আপনি কোন ধর্মের শিক্ষা দিচ্ছেন আপনার সন্তানকে?
এ কারণেই মনে হয়, আমাদের বোধগুলো ক্রমশই শূন্য হয়ে গেছে৷ নাহলে বাংলা তো সেই দেশ, যে দেশের মানুষ পাকিস্তান আমলে লড়াই করে টিপ পরার অধিকার অর্জন করেছিল৷ পাকিস্তানের অসুররাও বাংলার নারীদের টিপ পরার ওপর সরকারি ফতোয়া জারি করেছিল, নিষিদ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে; কিন্তু বাংলার মানুষ সেটা লড়ে জিতে নিয়েছে৷ আজ মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রজন্মের বোধটি হারিয়ে ফেলেছি বলেই আমরা বারবার খাবি খাচ্ছি৷ আমরা ভুলেই গেছি, আমাদের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে ব্যাপ্ত, সেখানেই আছে আমাদের প্রাণের বারতা৷ একটু শুধু ফিরে যেতে হবে সেই ঐশ্বর্যমণ্ডিত ইতিহাসের কাছে৷ বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্য আর ঐতিহ্যকে কোনো বকধার্মিক কখনো নষ্ট করতে পারেনি- ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয়৷