এমডিজি: মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের বেনজির সাফল্য
১৪ জানুয়ারি ২০০৯পশ্চিমবঙ্গে প্রসবকালীন মৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের থেকে কম তো বটেই, জাতিসংঘের রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশগুলির যে গড়, তার থেকেও কম৷ ১৯৯৮ সালে সারা ভারতে যেখানে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ছিল ৪০৭ জন, অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ২৬৬ জন৷ পরবর্তী পাঁচ বছরে জাতীয় হার যেমন কমে ৩০১ জনে দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতি মৃত্যর হারও কমে হয়েছে ১৯৪ জন৷ এই পরিসংখ্যান ইউনেসকোর মহিলা কমিশন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ রিপোর্ট থেকে নেওয়া৷ এর থেকে ধরে নেওয়াই যায় যে সন্তান জন্মের সময় প্রসূতি মৃত্যুর হার তিন-চতুর্থাংশ কমিয়ে ফেলার যে লক্ষ্যমাত্রা জাতিসংঘ স্থির করেছে, পশ্চিমবঙ্গ অত্যন্ত সফলভাবেই সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে৷
কিন্তু শিশু জন্মের পর, সদ্যপ্রসবা মা এবং সদ্যোজাত শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই কথা পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না৷ বিশেষ করে কেরল বা তামিলনাড়ুর মত রাজ্যে এ সংক্রান্ত সচেতনতার যে আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সেই তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে৷ একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক৷ ১২ থেক ২৩ মাস বয়সের শিশুদের সম্পূর্ণ টিকাকরণের ক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর শতকরা হার যেখানে ৮০.৮ শতাংশ, কেরলের ৭৫.৩ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের সেখানে ৬৪.৩ শতাংশ৷ কেন এমন হচ্ছে?
কারণটা মূলত অর্থনৈতিক৷ সন্তানসম্ভবা মায়ের যত্ন, সদ্যোজাত শিশুর যত্নের আগেও যেটা আসা দরকার, সেটা হল জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতনতা৷ বহু সন্তান হলে যেমন মায়ের স্বাস্থ্য খারাপ হয়, তেমনই শিশুর সার্বিক স্বাস্থ্যও ঠিক থাকে না৷ কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর সমাজে একটা ভুল ধারণা বহুদিন ধরেই চলে আসছে যে বাড়তি একটি সন্তান মানে বাড়তি একজোড়া কাজের হাত৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতে পরিবারের জন্য বাড়তি রোজগারের সম্ভাবনা৷ যে কারণে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে যেসব স্বেচ্ছাসেবী নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রাথমিক কাজই হয় জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অন্য মহিলাদের সচেতন করা৷ জানালেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক আর্থিক স্বনির্ভর সংস্থার সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী কৃষ্ণা নারু, তাদেরকে বোঝানো হয় যে ঠিক বয়সে যদি না বাচ্চা নেওয়া হয়, তাহলে সেটা তার পক্ষে খুবই ক্ষতিকর৷ এবং সেই সাবধানতার জন্য অনেক কিছু জিনিস রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা বলি৷ আগেকার দিনে তো এত সচেতনতা ছিল না৷ এখন ইদানীং যে সুবিধাগুলো হয়েছে, বাচ্চা বন্ধ হওয়ার দিক দিয়ে, যে সমস্ত জিনিসগুলো বেরিয়েছে, সেগুলো তো এখন অনেক উন্নত৷ সেইসব নিয়ে তাদেরকে জানানো হয়৷ এবং তারা অনেক সচেতন হয়েছে৷
মৌলিক এই অর্থনৈতিক সমস্যার আরও একটি দিক আছে, যেটার মোকাবিলা করতে হয় এই স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে পুরুষদের উপার্জনেই সংসার চলে এবং সেখানে মেয়েদের অর্থনৈতিক ভূমিকা যেহেতু প্রায় নেই, জন্ম নিয়ন্ত্রণই হোক বা সন্তানের স্বাস্থ্য বা শিক্ষা, সব ব্যাপারেই বাড়ির পুরুষদের মতামতটাই প্রাধান্য পায়৷ সমাজে মহিলাদের এই দুর্বল অবস্থানটা বদলাতে তাই নানা স্বনির্ভর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলে ওদের৷ যাতে ওরা নিজেরা রোজগার করতে পারেন, সংসার খরচের কিছুটা ভার নিজেদের কাঁধে নিতে পারেন, এবং সেই সুবাদে বাড়ির নানা ব্যাপারে স্বাধীন মতামত দেওয়ার অধিকার পান৷
আমার স্বামীর ইনকাম কম, একটা বাচ্চাকে লেখাপড়া শেখাতে গেলে হবে না৷ অতএব দুটোই বেস্ট৷ সে মেয়েই হোক, আর ছেলেই হোক৷ মেয়ে হয়েছে বলে ছেলের আশায় যে আরও তিন চারটে সন্তান নেব, এরকম ঠিক না. পরিস্থিতি এখন অনেক উন্নত৷ এই সংস্থার ফলে আমরা মাঝে মাঝে গ্রুপে যাচ্ছি, বসছি, আলোচনা করছি, আগের তুলনায় মায়েরা অনেক সচেতন, বলছিলেন স্বপ্না হালদার৷ ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল স্বপ্নার৷ সরকারি স্বনিযুক্তি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন সেই পড়াশোনাকে কাজে লাগানোর একটা রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন স্বপ্না৷ এখন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অন্য মহিলাদের মধ্যেও সেই সচেতনতার আলো ছড়াচ্ছেন স্বপ্না৷
তবে সমস্যার এখানেই শেষ নয়৷ রয়েছে ধর্মীয় বাধাও৷ বিশেষ করে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধবাদ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধক হয়ে থেকেছে৷ তবে ক্রমশ সেই অসুবিধার জায়গাটা দূর হয়েছে৷ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে আত্মবিশ্বাসী গলায় জানালেন স্বেচ্ছাকর্মী খুরশিদা বেগম, ধর্মীয় বাধার ব্যাপার যেটা আসছে, সেটা এখন পুরোপুরি বন্ধ বলতেই পারব৷ কেননা সমাজের সঙ্গে ওঠা-বসার ফলে এই দিকটা বন্ধ হয়েই গেছে৷ মানে আমাদের ধর্মবিরোধী যে দিকটা বলতে চাইছি, সে দিকটা এখন পুরোপুরি বন্ধ আমরা বলতেই পারি৷ কেননা আমাদের যে প্রত্যেক গ্রুপে বসা হয়, তার মাধ্যমে প্রত্যেক মা-ই এটা নিয়ে সজাগ৷ এবং পুরুষ যেটা আমাদের বাড়ির, পুরুষদেরও এক্ষেত্রে কোনও আপত্তি নেই৷
কিন্তু এখনও অনেকটা পথ পেরোবার আছে, মনে করেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক গ্রামীণ সামাজিক - অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা, ইআরডিএস-এর কর্মী তাপস বিশ্বাস৷ জানালেন, আমরা পশ্চিমবঙ্গে চারটে ডিস্ট্রিক্টে কাজ করছি৷ দক্ষিণ ২৪ পরগণা, মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং কলকাতার কয়েকটি অংশে৷ এইবার আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যে জায়গাগুলো এখনও, আমার চোখে মনে হয় যে জায়গাগুলো এখনও সরকার, বা আমাদের মত ছোটখাটো বেসরকারি সংস্থাগুলোর নজর দেওয়া আরও বেশি প্রয়োজন, সেগুলোর দিকে রয়েছে একটা সামজিক বৈষম্য৷ এবং কুসংস্কার৷ এই দুটো কিন্তু তৃণমূল স্তরে, গ্রাম স্তরে পড়ে রয়েছে যথেষ্ট ভাবে৷ যদি ছেলে না হয়, তাহলে বংশরক্ষা কে করবে৷ এই ধারণাটা কিন্তু আমরা নির্মূল করতে পারছি না৷ যেহেতু এই মা-কে নিয়ে বেশি বোঝানো হয়, বাবাদের কিন্তু, একটা বিরাট সেকশন রয়েছে, তাদেরকে আমরা, যেহেতু তারা কাজকম্ম করে, আমরা তাদেরকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে আসি না৷ প্রবলেমটা কিন্তু পুরুষদের নিয়ে৷
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একটা বিষয় কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়৷ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্নে সমস্যা যেমন আছে, সেই সমস্যা পার হয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার উদ্যোগ এবং সদিচ্ছাও আছে৷ ফলে সচেতনতা বাড়ছে৷ এমন দিন হয়তো দূরে নয় যেদিন এই পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই সব শিশুর বাসযোগ্য হয়ে উঠবে৷